চট্টগ্রামের সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট প্রকট। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে গত ৪ জানুয়ারি। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সরকারি কলেজগুলোতে দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। সেই তুলনায় বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা। অনেক কলেজের কোনো কোনো বিভাগে ধার করা শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান। আবার হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন একজন শিক্ষক। কিছু কলেজে নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আবার কোনো কলেজে পদ সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না দীর্ঘদিন। এতে শিক্ষক সংকট নিয়েই চলছে এসব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। চট্টগ্রাম নগরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ। এ কলেজও দীর্ঘদিন শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। কলেজটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৭৬ জন। বাংলা, ইংরেজি বিভাগে ৫–৬ জন করে শিক্ষক রয়েছেন, যেখানে দরকার ১৫–১৭ জন শিক্ষক। জানা গেছে, এই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান), স্নাতক (পাস) ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ১ হাজার ১৫০ জন। শিক্ষক আছেন মাত্র দুজন। তবে সমপ্রতি কলেজটিতে শিক্ষক পদ সৃষ্টির জন্য প্রস্তাবনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এতে ১৪৩ জন নতুন শিক্ষকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে পাস হলে প্রজ্ঞাপন আসলে সেই অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এক্ষেত্রে স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া হলে সংকট কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাজী মুহম্মদ মহসিন সরকারি কলেজ ছাড়াও শিক্ষক সংকট রয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ (বোয়ালখালী), সরকারি কমার্স কলেজ ও সাতকানিয়া সরকারি কলেজে। এসব কলেজ গত বছরের এপ্রিল মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরও চারটি কলেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো, সরকারি সিটি কলেজ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ (চন্দনাইশ), চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ ও পটিয়া সরকারি কলেজ। সবকটি কলেজেই শিক্ষক সংকট রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম মহানগর এবং চট্টগ্রামের নামকরা এসব কলেজে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক। অনেক কলেজের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এটি জাতির জন্য হতাশার। এতে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষার মান উন্নত হয় না ভালো শিক্ষক না থাকলে; বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি মানসম্পন্ন না হলে; শিক্ষাদান ও গ্রহণ আনন্দময় না হলে; শিক্ষায় হেরফের থাকলে; তিন–চার ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত থেকে গেলে, প্রতিটি কলেজে গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ এসব না থাকলে এবং শ্রেণিকক্ষ উজ্জ্বল ও আরামদায়ক না হলে। শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি সংকল্পবদ্ধ হয় শিক্ষাকে সংকটমুক্ত করতে, তাহলে ওই পথে অনেক দূরই এগিয়ে যাওয়া যাবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষক সংকটের সুরাহা করা জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ কলেজেই শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল। বিশেষ করে সামপ্রতিক সময়ে যেসব কলেজকে সরকারীকরণ করা হয়েছে, সেসব কলেজে সংকট সবচেয়ে বেশি। এর ফলে কলেজগুলোয় শিক্ষার মান যেমন নিশ্চিত হচ্ছে না, তেমনি নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হারও বাড়ছে।
অধ্যাপক কানাই দাশ তাঁর এক লেখায় বলেছেন, শিক্ষা ও শিক্ষকের বিদ্যমান অবস্থা পরিবর্তনে অব্যাহত লড়াই সংগ্রামের বিকল্প নেই। সর্বজনীন বিজ্ঞানমনষ্ক শিক্ষা ও শিক্ষকের বাঁচার দাবি আজ রাষ্ট্রের সার্বিক কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের তথা অর্থনীতি ও রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সম্পৃৃক্ত হয়ে পড়েছে। তা থেকে সরে আসার কোনো উপায় নেই। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নয়, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উদ্দীপ্ত করার কথা সীমিত পরিবেশ ও সুযোগের মধ্যেও শিক্ষক ও শিক্ষাব্রতীদের ভাবতে হবে। আনন্দ, স্বতঃস্ফূর্ততা, বিজ্ঞানমনষ্ক যুক্তিবাদী জিজ্ঞাসা, মুক্তচিন্তায় শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে মানবিক ও সহিষ্ণু ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে। শিক্ষকদেরও নিজেদের নিয়ত পরিশীলিত করতে হবে বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে।
সর্বজনীন মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক, ছাত্রের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তার মধ্যদিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা সকলের মৌলিক ও মানবিক অধিকার। তাছাড়া মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষক প্রাপ্তি সম্ভব। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো সম্বলিত নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মানসম্মত শিক্ষক অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সংকট নিরসনে পদ সৃজন, সঠিকভাবে পদায়নের পাশাপাশি দ্রুত নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন।