চট্টগ্রামের সরকারি কলেজগুলোতে দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। সেই তুলনায় বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা। অনেক কলেজের কোনো কোনো বিভাগে ধার করা শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান। আবার হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন একজন শিক্ষক। কিছু কলেজে নিয়োগে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আবার কোনো কলেজে পদ সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না দীর্ঘদিন। এতে শিক্ষক সংকট নিয়েই চলছে এসব কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম।
চট্টগ্রাম নগরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ। এ কলেজও দীর্ঘদিন শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। কলেজটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৭৬ জন। বাংলা, ইংরেজি বিভাগে ৫–৬ জন করে শিক্ষক রয়েছেন, যেখানে দরকার ১৫–১৭ জন শিক্ষক।
জানা গেছে, এই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান), স্নাতক (পাস) ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় ১ হাজার ১৫০ জন। শিক্ষক আছেন মাত্র দুজন। তবে সম্প্রতি কলেজটিতে শিক্ষক পদ সৃষ্টির জন্য প্রস্তাবনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এতে ১৪৩ জন নতুন শিক্ষকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে পাশ হলে প্রজ্ঞাপন আসলে সেই অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। এক্ষেত্রে স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া হলে সংকট কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাজী মুহম্মদ মহসিন সরকারি কলেজ ছাড়াও শিক্ষক সংকট রয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ (বোয়ালখালী), সরকারি কমার্স কলেজ ও সাতকানিয়া সরকারি কলেজে। এসব কলেজ গত বছরের এপ্রিল মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া আরও চারটি কলেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো, সরকারি সিটি কলেজ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ (চন্দনাইশ), চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ ও পটিয়া সরকারি কলেজ। সবকটি কলেজেই শিক্ষক সংকট রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম মহানগর এবং চট্টগ্রামের নামকরা এসব কলেজে শিক্ষক সংকটে রয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক। অনেক কলেজের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এটি জাতির জন্য হতাশার। এতে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিষয়ে স্নাতক চালুর ৬ বছরেও শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। ধার করা শিক্ষকে পাঠদান চলছে। এতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষক সংকট রয়েছে কলেজটির আরও পাঁচটি বিভাগে। কলেজটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট হাজার। বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ২৫ জন। কলেজ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে বিভাগ খোলা হয়েছে। এখন ধার করা শিক্ষক দিয়ে পাঠদান কার্যক্রম চলছে। শিক্ষক নিয়োগ দিতে কয়েকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হলেও কাজ হয়নি। শিক্ষক সংকট রয়েছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজেও। বর্তমানে কলেজটিতে উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৫৫ জন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ঠিকভাবে পাঠদান চালাতে গেলে অন্তত ২০৪ জন শিক্ষক প্রয়োজন। অন্যদিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় অবস্থিত স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। শিক্ষক সংখ্যা মাত্র ৩১ জন।
কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে স্নাতক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য বাংলা শিক্ষক আছেন মাত্র একজন। এতে করে সব শ্রেণিতে নিয়মিত পাঠদান সম্ভব হয় না। শিক্ষক সংকট রয়েছে সাতকানিয়া সরকারি কলেজেও। প্রায় ১ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক।
জানা গেছে, পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় নিয়মিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। কলেজটিতে ছয় হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৭৩টি। এর মধ্যে শিক্ষক আছেন ৪০ জন।
দীর্ঘদিন শিক্ষক সংকটে ভুগছে পটিয়া সরকারি কলেজ। কলেজটি সরকারিকরণ হয় ৪৪ বছর আগে। প্রতিষ্ঠানটিতে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৪৯ জন। কলেজটিতে সর্বশেষ নতুন শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়েছিল ১৯৮০ সালে। সে সময়ে এখানে শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়েছিল ৫৬টি। এরপর গত ৫৩ বছরে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় তিন গুণ হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে আর কোনো শিক্ষকের পদ সৃজন করা হয়নি। এমনকি কলেজটিতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছাড়া আর কোনো অধ্যাপকের পদ নেই।
১৪৩টি নতুন শিক্ষক পদ সৃজনের জন্য মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে বলে জানান সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। তিনি আজাদীকে বলেন, আমাদের অনার্স ও মাস্টার্সে শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয়নি। বিভাগে ৫–৬ জন করে শিক্ষক আছেন। এখানে বাংলা, ইংরেজি এরকম বিভাগগুলোতে ১৭ জন করে শিক্ষক লাগবে। অন্যান্য বিভাগগুলোতে ১৬ জন করে শিক্ষক লাগবে। আমরা শিক্ষা সমীক্ষা সাতাশি নীতিমালা অনুসরণ করে ১৪৩ জন নতুন শিক্ষকের পদ সৃষ্টির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাবনা দিয়েছি। সেটা যাচাই–বাছাই করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গেছে। সেটা পাশ হলে প্রজ্ঞাপন আকারে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের কলেজ দীর্ঘদিন শিক্ষক সংকটে রয়েছে। বছরে বছরে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে। সেই তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবল কাঠামো বাড়েনি। শিক্ষকের পদও সৃষ্টি হয়নি। যার কারণে প্রতিষ্ঠানকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে।
বিভিন্ন কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহ–সভাপতি প্রফেসর মো. আবু তাহের চৌধুরী। তিনি আজাদীকে বলেন, পাসের হার বেড়েছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে শুধু বাড়েনি শিক্ষকের সংখ্যা। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেসরকারি কলেজে অতিথি শিক্ষক রাখার সুযোগ রয়েছে সরকারি কলেজের অনেক ক্ষেত্রে সেটা থাকে না। শিক্ষক সংকট নিরসনের জন্য তিনি শিক্ষক নিয়োগে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারকদের। তিনি বলেন, সরকারের একটি পলিসি থাকবে, কত শিক্ষার্থীর জন্য কতজন শিক্ষক থাকবে। প্রয়োজনে স্পেশাল পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে। বেশিরভাগ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এটি হয় না। স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে সরকারি স্কুল কলেজগুলোতে কর্তৃপক্ষ তাদের চাহিদা জানাতে পারে। সেই অনুযায়ী সরকার শিক্ষক পদ সৃষ্টি করবে। পরবর্তীতে শিক্ষক নিয়োগ দিবে। এর মাধ্যমে শিক্ষক সংকট কমে আসবে।