স্যার আসতে পারি? ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা বলছি। আতঙ্ক ভয় ও একটি দ্বিধা নিয়ে দোতালার উপাধ্যক্ষ রুমে ঢুকতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি আমি। উত্তর আসে– আসুন! ঢুকে দেখলাম উপাধ্যক্ষ স্যার বসে আছেন। তাঁর সামনে দুটি চেয়ার। আমাকে বললেন, বসুন।
আমি বসলাম, এ পর্যন্ত স্যারের সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হল। কখনো লিখিত পরীক্ষার হলে, কখনো ক্লাস ডেমোতে, কখনো ভাইভা বোর্ডে। কোনটার সাথে কোনটার মধ্যে স্যারের একরকম রূপ আমি দেখিনি। কখনো হাসি মাখা মুখ দেখেছি, কখনো রেগে খুব জোরে কথা বলতে, আবার কখনো বেশ গম্ভীর। তাই আমার ভেতরে ভয় হচ্ছিল আসলে স্যার কেমন? জয়েন এর প্রথম দিন বেশ কিছু সৌজন্যমূলক কথা বলা হলো স্যারের সাথে। একটি কথা আমার মনে গেঁথে গেল বললেন এখানে শাহীন কলেজ মানে একটি পরিবার, বড়দের শ্রদ্ধা করবেন, ছোটদের স্নেহ করবেন। সকলে মিলে মিশে থাকবেন কোন সমস্যা হলে অবশ্যই জানাবেন। হঠাৎ আমার নিজের বাবার চেহারাটা ভেসে উঠলো। আমার বাবাও একজন প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনিও সব সময় সকল শিক্ষককে আপন করে এভাবে বলতেন ও সাহায্য করতেন। স্কুলের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন আন্তরিকতার সাথে। আজ আমার কেন জানি বাবার কথা খুব মনে পড়ল মনে হলো যেন কথাগুলো বাবা বলছে এতক্ষণ। শ্রদ্ধায় মাথা নত করলাম। আমি আজ যার কথা লিখছি, তিনি হলেন শাহীনের অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন স্যার।
নাসির স্যারের অসংখ্য গুণ, কর্মজীবন ও একজন শিক্ষক কতটা প্রশংসার দাবীদার তা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না। ২০০৩ থেকেই আমি স্যারকে দেখি এই এত অল্প সময়ে স্যারকে যতটুকু চিনতে পেরেছি বা বুঝতে পেরেছি তিনি সুযোগ্য একজন শিক্ষক এবং বিশাল বড় মনের একজন মানুষ। কাজের ক্ষেত্রে মানুষের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভিন্ন রুপ দেখতে পাই। তবে ভেতরে মনের একটা সুন্দর দিক চাপা থাকে যেটা শুধু মাত্র খুব কাছের মানুষেরা দেখতে পান। বাইরে তিনি বেশ কঠোর, মনের ভেতর তিনি অনেক উদার ছিলেন। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন স্যার বেশ কয়েকবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন শাহীন কলেজে। যোগদান করেন তিনি বি এ এফ শাহীন কলেজে০১–০৭– ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন স্যারের জন্ম ৩১–০১– ১৯৫৯ সালে, পিতা —মোঃ শফি, মাতা —সখিনা বেগম। গ্রাম– মনসা, ডাকঘর– মনসা , উপজেলা– পটিয়া চট্টগ্রাম এ জন্ম। উনারা তিন ভাই ও তিন বোন। ভাইদের মধ্যে মেজো ভাই হলেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন স্যার। বিএএফ শাহীন কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন ১৯৮৫ সালে।যোগদান করার পর থেকে দক্ষতা, ও কর্ম নিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হন। আরো প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার ফলে উপাধ্যক্ষ পদে পদন্নোতি পান। উপাধ্যক্ষ পদে থাকা অবস্থায় অনেক বেশি কর্মনিষ্ঠ, সুযোগ্য, কর্মতৎপরতা, আন্তরিকতা, ও উদ্যমের কারণে তিনি ২০০৭ সালে অধ্যক্ষ পদে পদোন্নতি পান। সকলের আগে কলেজে উপস্থিত থাকতেন নাসির স্যার। অফিসের আয়া পিয়ন, এদেরও মাঝে মাঝে দেরি হতো কিন্তু স্যারের কখনো দেরি হতো না। প্রতিটি দিকে ছিল সুনজর। দায়িত্ব সম্পন্ন ও নিষ্ঠাবান একজন অধ্যক্ষ কলেজ কে ভালোবেসে সকাল, বিকেল, রাত কাটিয়ে দিতেন কলেজের উন্নতির চিন্তায়। সকলের আগে এসে বাসায় যেতেন ছুটির পর সকলের শেষে। আবার কাজ থাকলে দুপুরের খাবার পর আবার চলে আসতেন কলেজে। শাহীন কলেজই ছিলো ধ্যানজ্ঞান।
ছুটি নিতে দেখা যেত না কখনো স্যারকে।একবার মায়ের খুব অসুস্থতার জন্য ছুটি নিতে হলেও তিনি সকালে কলেজে এসে তারপর বিকেলে চলে যেতেন হাসপাতালে সারারাত মায়ের সেবা করতেন আবার পরের দিন এসে কলেজ করতেন। মাকে ভালোবাসতেন প্রচণ্ড। মায়ের মৃত্যুতে কেঁদেছে অঝোর ধারায়। এই প্রথম মনে হল তিনি ভেঙে পড়েছিলেন কখনো তাঁকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি এর আগে। সবসময়ই কঠোর, সাহসী, স্পষ্ট শক্ত মনের হতে দেখা গিয়েছিল। নিয়ম শৃঙ্খলায় তিনি ছিলেন অনেক বেশি কঠোর। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে সঠিক সময়ে আসা, পোশাক যথাযথ পাঠদান হেয়ার কাট, সঠিক নিয়ম কানুন সবকিছুই তিনি খুব সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার মাধ্যমে সুচারুভাবে পালন করতেন। কখনো চেয়ারে বসে আরাম আয়েশ করতেন না, সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি কাজ পাঠদান পর্যবেক্ষণ করতেন। মাঝে মাঝে ক্লাসের পেছনে বসে শিক্ষকদের পাঠদানও দেখতেন। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে এবং কলেজে শিক্ষকদের নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হওয়ার জন্য কলেজ বাসের ব্যবস্থা চালু করার পারমিশন নিয়ে কাজ শুরু করেন। যাতায়াতে বাস সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। সেই ধারাবাহিকতায় আজ শাহীন কলেজে নিজস্ব পাঁচটি বাস চালু হয়েছে। দীর্ঘ ৩৫ বছর চাকরিজীবনে অনেক অনেক শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষিত করে বিভিন্ন বড় জায়গায় দায়িত্ববান সম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তুলেছেন নাসির স্যার। প্রতিষ্ঠিত হয়ে শিক্ষার্থীরা মুখ উজ্জ্বল করেছে শাহীন কলেজের। চিন্তাভাবনায় নাসির স্যারের জড়িয়ে থাকতো বিএএফ শাহীন কলেজের উত্তরোত্তর উন্নতির চিন্তা। শিক্ষার্থী, অফিস স্টাফ, আয়া, পিয়ন সকলে যেমন ভয় পেত তেমনি স্যারকে পছন্দও করতেন অনেক।
সকলের পরিবারের খবর নেয়া, বিভিন্নভাবে সাহায্য করা, দুঃখে বিপদে পাশে দাঁড়ানো এই সবগুণ ছিল স্যারের মধ্যে। নৈতিক গুণের অধিকারী তিনি, মা ভাইবোনদের প্রতিও ছিলেন দায়িত্ববান। ছোট ভাইকে নিজের কাছে রেখে পড়ালেখা সম্পন্ন করান। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন। ছোট ভাই বর্তমানে পটিয়া কলেজের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। তিনিও খুবই আন্তরিক ও সহযোগিতা সম্পন্ন সকলের প্রতি।স্যার যখন যেটা করা দরকার , সেই সব পূরণ করার চেষ্টা,ও নিজ দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন।
নাসির স্যার সুযোগ্য দুই পুত্রের জনক তিনি। বড় ছেলে ব্যাংকার ও ছোট ছেলে নরওয়েতে উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি অর্জনের পথে। নাসির স্যারের সহধর্মিনী একজন অমায়িক, বুদ্ধিমতী ও ধৈর্যশীলা নারী তিনি। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন, সন্তানদের মানুষ করা, সকল সুযোগ–সুবিধা দায়িত্ব পালন, আত্মীয় পরিজনদের প্রতি কর্তব্য শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি সেবা প্রত্যেকটি কাজ করেছেন সুপরিপাটিভাবে।
নাসির স্যারের কথা বলতে গেলে আসলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে তাঁর কর্মজীবনের দিন বছর হিসেব করে লিখলেতো লেখা শেষ হবে না। আমি শুধু কিছু গুণ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিমাত্র। সামান্য মেধায় স্যারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, কোন কিছুই সঠিকভাবে লিখতে পারছি না। স্যারের এত দক্ষতা এত যোগ্যতাএই সবকিছু লেখা খুবই অসম্ভব। সারের এত সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মেধা ও সহমর্মিতা আচরণ সকল শিক্ষক, প্রতিবেশী ও বিমান বাহিনীর প্রধান, বেইজ কমান্ডার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন, অফিসার সকলকে মুগ্ধ করেছে। শিক্ষক তো তিনিই, যার সবকিছুই শিক্ষণীয়। অনেক কাজ করতে গেলেই কিছু তো ভুল হতেই পারে কিন্তু আমার মনে হয় স্যারের প্রতিটা কাজ ছিলো নির্ভুল। কাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে হয়, কার কি গুণ আছে, কে কোথায় দায়িত্ব পেলে উন্নতি করতে পারবে; কলেজের সব কিছু উন্নতি কিভাবে হবে সব ছিলো মুখস্থ। প্রত্যেক শিক্ষক সম্পর্কে ধারণা ছিলো বেশ সুন্দর।
নাসির স্যারের পরিচিতি শুধুমাত্র কলেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না গ্রামে শহরে ও বিভিন্ন কর্ম ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে আছে আজও। যেসব শিক্ষার্থী ছিল দুষ্ট তারাই বেশি স্মরণ করে আজ। এছাড়াও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিভন্ন অনুষ্ঠানে স্যারের উপস্থিতি যেন সবার কাম্য। তিনি সকলের মনের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন। সকলের মাঝে ছড়িয়ে রয়েছে সুনাম, বেশ প্রশংসার দাবিদার তিনি। বিএএফ শাহীন কলেজে তিনি ইংলিশ মিডিয়াম চালু করার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষতার পরিচয় দেন এবং ইংরেজি মাধ্যমকে সুন্দরভাবে বছরের পর বছর সুনামের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সাধিত করেছেন। অসাধারণ একজন মানুষ তাইতো তিনি ২০১৯ সালে নেওয়ার পর দিনেই যোগদান করেন প্রিন্সিপাল পদে অন্য একটি কলেজে। নেওয়ার পর একদিনও বসে থাকতে হয়নি।
প্রদীপ যেমন আলো দেয়, তেমনি স্যার শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে আলোকিত করেছেন অনবরত। সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের জীবন, কর্মচারী পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়–স্বজন সবার মাঝে অনন্য মানুষ হিসেবে মনের মাঝে স্থান করে নিয়েছেন নিজের গুণ দিয়ে। স্যারের দীর্ঘায়ু, সুস্থতা, সুস্বাস্থ্য ও আনন্দময় জীবন কামনা করছি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।