শিক্ষক তিনি, যিনি তাঁর অনুসারীদের জ্ঞান ও ন্যায় দীক্ষা দেন, শিক্ষাদানের মহান ব্রতকে জীবনের পাথেয় করেন এবং জাতি গঠনের কারিগরি দক্ষতা দেখান। এক অর্থে, স্বীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে তাদেরকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব যিনি কাঁধে নেন, তিনিই শিক্ষক।
নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এক আনন্দের নাম হলো শিক্ষকতা। আমিও একজন শিক্ষক। শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের মাঝে দাঁড়ান, তখন তিনি সূর্য। আলো ছড়ানোয়ই তাঁর কাজ। শিক্ষক এমন এক সুরের নাম, সুমধুর মূর্ছনা ছড়ানোতেই তাঁর তৃপ্তি! শিক্ষক, একজন মাঠের চাষি। তাঁকে নরোম তুলতুলে মাটিতে চাষ করতে হয়! জিজ্ঞাসার বীজ বুনে দেয়া তাঁর মহান কর্তব্য। শিক্ষক মানে অধিপতি! তাঁর সামনে সব রাজন্যবর্গ আর পৃথিবীকে বদলে দেয়ায়ই তাঁর কাজ। সব মিলিয়ে শিক্ষকতা মানে এক অপার আনন্দ। শিক্ষকতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য হলো, আনন্দের স্পর্শে জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে সাহায্য করা। জীবনের সবচেয়ে রঙিন, ছটফটে, সবচেয়ে উর্বর সময়টিতে মানুষ জ্ঞানার্জনে রত থাকে! তখন আলো– আঁধারের পার্থক্য বুঝানো, সত্য ও ন্যায়, প্রজ্ঞা আর সহিষ্ণুতার পথ দেখান শিক্ষকরা। তাঁদের ধ্যান ধারণা, চিন্তার গাঁথুনিতেই শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন’। শিক্ষকই প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করেন। তাই বলা হয়, শিক্ষকতা হলো অঙ্গিকার। শিক্ষকের চিন্তা আর প্রকাশের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে আমাদের জীবন দর্শন। সেজন্য শিক্ষক মানে জীবনচাষিও! একজন বড় চেয়ারধারী মানুষ চেয়ার থেকে সরে গেলে আর স্যার‘ ডাকটা শুনতে পান না! কিন্তু শিক্ষক মৃত্যুর পরও স্যার‘ই রয়ে যান! তাই শিক্ষক মানে জীবনের আলো।
‘শিক্ষকতা হল সেই পেশা যা অন্য সব পেশার সৃষ্টি করে’। শিক্ষক রোপণ করেন আনন্দবীজ। আনন্দবীজ থেকে চালিত হয় জাতি। শিক্ষকদের সম্মান করা জাতিই হয়ে ওঠে সভ্য, উন্নত ও হৃদয়বান। শিক্ষকতা পেশার থেকে মহত্তম পেশা আর হতে পারে না। শিক্ষকদের আলো ছড়ানোর মাধ্যমেই সত্য আর সুন্দরের প্রসার ঘটে পুরো পৃথিবীতে। আনন্দের সাথেই বলেছি, আমিও শিক্ষক। আমাদের শিক্ষকগণ আমাদের প্রতি যেরকম আচরণ ও মনোভাব প্রদর্শন করতেন, তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে ভীষণ বেমানান! আমরা একটা ভীতিকর পরিবেশে আমাদের শিক্ষার্থীজীবন পার করে এসেছি। অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করেই বলছি, তখনকার সময়ে আমাদের জন্য হয়তো তা প্রয়োজনও ছিলো! শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষার্থীর হৃদয়ের মডেল। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এ যুগে, শিক্ষক– শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে মধুর। একজন শিক্ষক ঠিক কতোটা শিক্ষক হয়ে উঠেছেন, সেটা নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা তাকে কতটুকু ভয় পায় সেটার উপর? আমাদের শিক্ষকরা ভাবতেন, শিক্ষার্থীরা তাকে যত বেশি ভয় পায়, শিক্ষক হিসেবে তিনি তত সফল! শিক্ষকদের এমন মানসিকতা এখনো বহাল থাকলে, এ মহান পেশার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা ছাড়া কিছুই নয়!
‘একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই এবং একটি কলম পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে’। কিন্তু এর বিপরীত দিকটাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। যাঁদের হাতে পৃথিবী বদলে দেয়ার সামর্থ্য আছে, তাঁদের উদাসীনতা কিংবা অদক্ষতায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে! ‘একজন ভালো শিক্ষক মোমবাতির মতো। এটি অন্যের পথ আলোকিত করার জন্য নিজেকে গ্রাস করে’. কিন্তু সেসব শিক্ষকদের জন্য বলতে হয়, ‘যে প্রদীপ নিজে জ্বলে না, সে প্রদীপ কখনোই অন্য প্রদীপ জ্বালাতে পারে না’। স্নেহ–ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা–সম্মানে যে সম্পর্ক রচিত হয়, সে সম্পর্ক যেনো সবসময় অটুট থাকে– ভাববার সময় এখনই! এ মধুর ও পবিত্র বন্ধনে চিড় ধরলে জাতি পঙ্গু হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছি। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের শিক্ষক। শিক্ষক নিজে ভালো মনের হলে তবেই তিনি ভালো শিক্ষক তৈরী করতে পারেন। আর এভাবে সৃষ্টিশীল ও উদার চিন্তাভাবনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। শিক্ষক – শিক্ষার্থীর মধ্যে নিবিড় বন্ধন রচিত হোক। কৃত্রিম প্রাচীর ও রক্ষণশীলতা ভেঙে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠুক। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এটাই। চলুন আমরা বদলে যাই, বদলে যাবে সমাজ।