বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ। বিশ্বের সমস্ত শিক্ষকদের অসামান্য অবদান স্মরণ করতে এই দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ সভায় ৫ অক্টোবর দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের সরকার ও এডুকেশনাল ইন্টারন্যাশনাল–ইআই সহ ৪০১টি শিক্ষক সংগঠন প্রতি বছর ঘটা করে দিবসটি পালন করে থাকে। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে– জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শিক্ষকদের মর্যাদা ও মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষকের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করা, মানসম্মত শিক্ষা তথা সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং প্রবীণ শিক্ষকদের অভিজ্ঞতাকে জানা ও কাজে লাগানো।
ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকরা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা, উপলব্ধি সৃষ্টি ও শিক্ষকদের ভূমিকার স্বীকৃতিস্মারক হিসেবে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকরা তাদের ভূমিকা রেখে চলেছেন।
যিনি শেখান তিনিই শিক্ষক, সেই তিনি যে পর্যায়েরই হোন। ম্যাক্সিম গোর্কি ডাস্টবিনের কুকুরকেও তার শিক্ষক মানতেন। পেটের ক্ষুধা সবারই সমান। পৃথিবীর ১২৭ ভাষায় অনূদিত গোর্কি কোনো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষালাভ করেননি। বিশ্বজোড়া পাঠশালারই ছাত্র তিনি। শিক্ষকেরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। একজন আদর্শ মানুষ গড়তে আদর্শ শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকের স্থান ঈশ্বর ও মা–বাবার পরেই। এটি চাকরি নয়। শিক্ষকের জয় সবসময়। যদিও নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণে, দীর্ঘশ্বাসে, বোবাকান্নায় আজ চারপাশ। তাই শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাধীনতা, মর্যাদা বৃদ্ধি, আবাসন, যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে এগিয়ে নেয়ায় অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তি। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষকের অংশগ্রহণ মানুষকে আলোকিত হতে সাহায্য করে। কোনো বিষয় চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে শিক্ষক ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং ঐ জ্ঞানের জ্যোতির দ্বারা নিজে আলোকিত হতে ও সমাজকে জ্যোতির্ময় করতে সহায়তা করে। শিক্ষকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই শিক্ষার্থীর মন–মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন হয়, আচার আচরণ, মন ও আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটে, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক। কার্যত শিক্ষক বলতে একজন আলোকিত, জ্ঞানী–গুণী ও বুদ্ধিদীপ্ত পণ্ডিত ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি সভ্যতার বিবর্তনের অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষা দিতে নিবেদিতপ্রাণ সেবক, ব্যবসায়ী নন। তিনি তাঁর আচার–আচরণ, মন ও মননে নিজেই বটবৃক্ষের প্রতীক। তাঁর সাফল্যের ভিত্তি হল পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, নির্মল চারিত্রিক গুণাবলি, জ্ঞান সঞ্চারণে আন্তরিক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা। তাই শিক্ষক বলতে এমন এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ববান জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে বোঝায়; যিনি শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায়, জ্ঞান অন্বেষণ ও আহরণে, মেধা বিকাশ ও উন্নয়নে, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানসিক গুণাবলি অর্জনে এবং সমাজ বিবর্তনে অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির সহায়তা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত করা হয়। এই মেরুদণ্ডকে সোজা রাখার জন্য শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়ের মানোন্নয়নে সরকারকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯০% এর ওপরে বেসরকারি শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে জানা যায়, ‘আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অবস্থান অনুযায়ী কোন ধরনের উন্নত সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকেন না। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সকল ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষকদের থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত। শহরকেন্দ্রিক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা থাকলেও গ্রামে–গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সুযোগ সুবিধা পান না। শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি ছাড়া প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা সরকার প্রদত্ত মাসিক ভাতার ওপরে জীবন–জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষকদের তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২৫% বোনাস নিয়ে সব ধরনের উৎসব পালন করতে হয়। যে পরিমাণ শিক্ষকরা বোনাস পেয়ে থাকেন তাই দিয়ে পরিবারের সকলের আবদার পূরণ করা সম্ভব নয়। পদোন্নতির বিষয়টির ক্ষেত্রে এতদিন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি। অনেক কলেজ শিক্ষককে সারা জীবন চাকরি করে প্রভাষক হয়েই অবসরে যেতে হয়েছে। গত দুই বছর থেকে ১৬ বছর পূরণ হওয়ার পরে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়। কিন্তু পদোন্নতির সাথে সাথে কোনো ধরনের সুযোগ–সুবিধা যোগ করা হয়নি।’
তাই সর্বজনীন মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক, ছাত্র অভিভাবক, বিভিন্ন পেশার মানুষ ও সরকারের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। তার মধ্যদিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।