নভেম্বর আসলেই নস্টালজিয়া কাজ করে। সেই অসম্ভব সুন্দর সকালটি এখনো মনে পড়ে। সেইদিনের সেই কুয়াশার ঘ্রাণ পাই এখনো। যেদিন চলতে শুরু করেছিলাম আমার স্বপ্নময় পথ ধরে। জীবনের সবচে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার দিন ছিল সেই ৯ নভেম্বর ২০১৪। বাবার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। যদিও আমি সেভাবে ভাবিনি কখনো। কূটনীতিক হতে চেয়েছিলাম মনে মনে, যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রী ছিলাম। পড়াশোনায় বরাবরই মনযোগী ছিলাম। স্নাতকে প্রথম এবং স্নাতকোত্তর এ দ্বিতীয় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করলাম। এর পরই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি শুরু হল।
২০১৪ সালে নভেম্বরের একটি শীতল সকালে আমি বিভাগে যোগদান করলাম। নতুন পরিচয় হল প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই পরিচয় যেন জীবনের সাথে মিশে গেল। শিক্ষকতা আমার কাছে কোন চাকরি নয় এটি যেন আমার ধর্ম, আমার সাধনা। আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে এই মহান ব্রত।
প্রথম ক্লাসটির স্মৃতি এখনো আমাকে নাড়া দেয়। মনে হয়, এই ত সেদিন প্রথম বর্ষে প্রথমবারের মতন গেলাম, বই–খাতা এবং একটি মার্কার হাতে নিয়ে। অনেকগুলো নতুন নতুন অজানা মুখ কৌতূহলী চোখ আমাকে দেখছিল। আমি ছিলাম তাদের নতুন শিক্ষক। কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর একজন ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে তার আমার প্রতি তাদের মুগ্ধতা প্রকাশ করল। আমি আশায় বুক বাঁধলাম। বুঝতে পারলাম আমি পারব।
আজ ৯ নভেম্বর। আমার কর্মজীবনের এগারো বছর পূর্ণ হল। চোখের পলকে কত দ্রুত এত লম্বা পথ পাড়ি দিলাম তা ভেবে অবাক লাগে। নিজের বিভাগে এই এগারো বছরে আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছি একেবারে নতুন রূপে। দিনে দিনে আমার ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে আমি হয়ে উঠেছি একজন পরিপূর্ণ মানুষ। আমি কেবল তাদের শিক্ষক হয়ে শ্রেণীকক্ষে তাদের পাঠ দান করছি না, আমি প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে শিখছি। তাদের আয়নার মত স্বচ্ছ চোখে পুরো পৃথিবীকে দেখছি। এখানে শিক্ষকতা করতে এসে আমি জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দেখার একটি আয়না। এখনে জন্ম নেয় নেতৃত্ব, এখানে জন্ম নেয় চেতনা এবং মূল্যবোধ। কাদামাটির মতন নরম কিছু সত্তাকে সুনাগরিক এবং মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করার দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর এসে পড়ে। প্রতিটি ক্লাসে প্রতিটি চোখ, তাদের প্রশ্ন এবং কৌতূহল, জানার আগ্রহ আমাকে দিন দিন পরিপক্ক করেছে। তাদের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভা আমাকে বিস্মিত করে। আমি একটি মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখি।
এই এগারো বছরে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ। আমি দেখেছি নারীরা কিভাবে এখনো নিজের জায়গা করে নিতে লড়াই করে যাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা এবং কণ্ঠস্বর এখনো আমাদের সমাজে উপেক্ষিত। নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে গিয়ে নারীকে অনেক সময় একই কাজ বারেবারে করতে হয়।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমার চোখ দিয়ে আমি কেবল নিজে সম্মুখীন হওয়া প্রতিবন্ধকতা শুধু নয় আমি আমার নারী শিক্ষার্থীটির কঠিন জীবন সংগ্রামের চিত্র ও দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের অনেক নারী শিক্ষার্থী অদম্য ইচ্ছা এবং চোখে অপার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। কিন্তু পরিবার এবং সমাজ সৃষ্ট নানাবিধ জটিলতায় তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারী শিক্ষার পথে একটি তীব্র বাধা হল অধ্যয়ন চলাকালীন বিবাহ। পড়াশোনা চলাকালীন পরিবারের চাপে বিয়ে হয়ে যাবার কারণে অনেক নারী শিক্ষার্থী স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। সন্তান জন্মদান সহ নানান পারিবারিক চাপে নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
এই এগারো বছরে বেশ বুঝতে পারছি মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে সব বাধা আসলেই নস্যি। চলার পথে এতো বাধা বিপত্তি থাকার পরেও অনেক নারী শিক্ষক তাদের শিক্ষা এবং গবেষণা চমৎকারভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি নিজেও ব্যক্তিগত অনেক সংকট পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় সফলতার সাথে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের এই কর্মজীবনের প্রাণ। তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই আমাদের সকল প্রচেষ্টা। আমি শিখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ছাত্রছাত্রীদের পাঠ দানের জায়গা নয়। নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়া এবং সেই জ্ঞান কে সংরক্ষণ করার জায়গা হল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর সম্ভাবনার জায়গাটিকে আবিষ্কার করে তাকে সেই অনুযায়ী উৎসাহ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা শিক্ষকদের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার সাথে সাথে তাদের যথার্থ মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাও প্রতিটি শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব।
শিক্ষকতার এগার বছর পূর্তিতে আমি আমার সেই সত্তাকে অভিনন্দন জানাই যার অপ্রতিরোধ্য মনোবল এবং সাহস আমাকে আজকের দিন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। আজকের দিনে আমি কামনা করি একজন সফল মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে আমি যেন নিজেকে এবং আমার শিক্ষার্থীদের আলকিত করতে পারি। এক ঝাঁক সাদা পায়রার মত ছাত্রছাত্রীরা যেন পুরো বিশ্বে শান্তি ও মানবতার বার্তা পৌঁছে দেয়। এগারো বছরের এই পূর্ণতার লগ্নে এটাই আমার প্রত্যাশা। ওরা শান্তির দূত হয়ে এই গ্রহের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়লে সেই হবে আমার প্রাপ্তি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।











