শিক্ষকতা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অভিজিৎ বড়ুয়া মানু | বৃহস্পতিবার , ৭ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

গত ৫ অক্টোবর চলে গেল বিশ্ব শিক্ষক দিবস। একই সাথে শিক্ষকতা পেশায় আমার ২৫ বছর পূর্তি হলো। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেও এক পর্যায়ে নেশায় পরিণত হয়। কিশোরবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবো এবং পাশাাপাশি খামারী হবো। অন্যথায় সাংবাদিক হবো। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলেও খামার করা আর হয়ে উঠেনি। তবে পাশাপাশি মফস্বল সাংবাদিকতাও কিছুদিন করেছি।এখনো রিপোটিং করতে ভাল লাগে।তাই বন্ধুমহলে সাংবাদিকদের সংখ্যাটাও কম নয়।নিজের অজান্তেই পেশাটা শুধু নেশায় নয়,ভালবাসায়ও রূপ লাভ করে। যখন শ্রেণিকক্ষে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াই তখন ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনূভব করি। সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার তাগিদ। তাদের মাঝে স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদ। সিলেবাসভিত্তিক পড়ালেখার পাশাপাশি সব সময় চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানপিপাসা সৃষ্টি করতে।মানবিক মুল্যবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। সে লক্ষ্যে সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম যেমন বইপড়া,সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা,নিয়মিত খেলাধুলা এবং স্কাউটিং কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে তাদের অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করি।আমি বিশ্বাস করি প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকই এ চেতনাগুলো কমবেশী ধারণ করেন। সহজ কথায় একজন শিক্ষক হবেন স্বাধীনচেতা, দৃঢ় মনোবল ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, পেশার প্রতি দায়বদ্ধ এবং সর্বোপরি সৃজনশীল। আজকাল একটা কথা প্রায় শোনা যায় বিদ্যার্থী বা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে ,বাড়ছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। অর্থাৎ জ্ঞান আহরণের চেয়ে পরীক্ষা পাশের জন্য তথা সার্টিফিকেট নির্ভর পড়ালেখার দিকেই আমরা বেশী ধাবিত হচ্ছি। তাই পরবর্তী প্রজন্ম কতটুকু মননশীল হয়ে গড়ে উঠছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইব্রেরি ওয়ার্ক,

ম্যাগাজিন,গল্প-উপন্যাস পড়া,খেলাধুলা এগুলো এখন স্বপ্নকথা। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরির দৈন্যদশা। অনেক প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরিয়ানও নেই কিম্বা পরিত্যক্ত কোণের রুমটাতেই তার অবস্থান। আলমারির থাকে, বইয়ের ভাজে,টেবিলে হয়তো ধুলোর প্রলেপ পড়েছে,পোকায় কাটছে। চোখ ধাঁধানো চমকপ্রদ অনুষ্ঠান-উৎসবে আমরা মাতোয়ারা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আগের মতো বিতর্ক প্রতিযোগিতা কিম্বা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা,বাগান করা অনেকটাই আজ ম্রিয়মান।এটা কি শিক্ষাব্যবস্থা বা সিষ্টেমের দোষ?নাকি আমাদের শিক্ষকদের? নাকি শিক্ষার্থীদের মাঝে আমরা স্বপ্ন ও আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারছিনা।নাকি আকাশ সংস্কৃতির কারণে যুগের হাওয়া বদল। যদিওবা জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগের কারনে ফুটবল খেলাটা কিছুটা হলেও ঢিমে তালে টিকে আছে। এককালে শিক্ষকতা পেশায় অনেকেই এগিয়ে আসতো। বলা যায় আদর্শ , মর্যাদা ও সম্মানের খাতিরেই। বর্তমানে মেধাবীরা এ পেশায় আসার ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। সামাজিক মর্যাদার অভাব,অথের্র অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষকতা পেশা মেধাবী তরুণ-তরুণীদের আর আকর্ষণ করতে পারে না। এ পেশায় থেকে সংসার চালানোটা কষ্টকরই শুধু নয় অনেকটা দুরুহও বটে। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী কলেজ শিক্ষকদের কথা বাদ দিলে প্রায় সকল শিক্ষকদের অবস্থা বা চিত্র এক রকম। তার উপর এ আদর্শ পেশাতেও মরীচিকা লেগেছে।এ ক্ষেত্রে নানা সংকট-নৈরাজ্য যেমন রয়েছে তেমনি শিক্ষার মান গিয়েছে নেমে। সংখ্যানুপাতে পাশের হার বাড়লেও শিক্ষার্থীর মান বা মেধা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অপরদিকে এ পেশাজীবীদের অনৈক্য, সুবিধাবাদিতা, কারো কারো নীতিহীনতার চর্চার কারণে এ ঐশ্বর্যমণ্ডিত পেশা যেমন কলঙ্কিত হচ্ছে তেমনি নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই-সংগ্রাম বিফলে যাচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রসমূহে শিক্ষকদের সম্মান -মর্যাদা ও বেতন সবচেয়ে উঁচুতে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও আমরা তাই দেখি। অপরদিকে বেতন বৈষম্যতো আছেই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও শিক্ষকদের মর্যাদার জন্য পথে নামতে হয়। মাঝে মাঝে হতাশা -দৈন্যতার চোরাগলিতে আটকা পড়ি। স্বপ্ন আর বাস্তবতার আকাশ ছোঁয়া ব্যবধানে নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হয়, বিধ্বস্ত হই। আবার কিছু অসাধারণ সুহৃদ আর কর্মপাগল কয়েকজন সহকর্মীর কারণে আবার উঠে দাঁড়াই। স্বপ্ন ছড়াই। মনকে প্রবোধ দিয়ে নীতি আদর্শকে আঁকড়ে পড়ে থাকি। হয়তো আমার জীবনায়নের সাথে অনেকের জীবন কাহিনি মিলে যাবে। এটাই বর্তমান সময়ের সমাজ বাস্তবতা। যে শিক্ষক নীতি-নৈতিকতার উন্মেষ ঘটাবেন, সমাজ-সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করবেন তাদের যদি আর্থিক দুরবস্থার কারণে অসম্মানজনক জীবনযাপন করতে হয় তবে তারা আদর্শের প্রতীক হয়ে শিক্ষা দান করবেন কীভাবে? তাই তাদের সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক জীবনের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা বিধান জরুরি। তবেই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন সহজ -সাবলীল হবে। তারপরও লক্ষ লক্ষ শিক্ষক শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে, লোভ-মোহ-সুখের হাতছানিকে ডিঙ্গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানপিপাসা জাগাতে,মানবিক মানুষ হিসেবে তথা আগামী দিনের দেশপ্রেমিক যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে।একজন শিক্ষক কেবল পাঠ্যপুস্তকের ব্যাখ্যাতাই নন, সভ্য সমাজের রূপকারও বটে। আলোকবর্তিকা হাতে শিক্ষকগণই অজ্ঞানতা, অশিক্ষার অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে সভ্যতার অভিমুখে চলবার পথনির্দেশ করে থাকেন। বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে সে সকল আলোর ফেরিওয়ালাদের শ্রদ্ধা-ভালবাসা।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার ভালো লাগা, আমার প্রেম
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল