শাহ সুফী আমানত খান (রাহঃ ) : চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক বাতিঘর

মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম | বুধবার , ২৮ মে, ২০২৫ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি পরম করুণাময়। সালাম ও বরকত বর্ষিত হোক আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সাহাবীগণের উপর।

বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্ব উপকূলীয় শহর চট্টগ্রাম শুধু বাণিজ্যিক নগর নয়, আধ্যাত্মিকতারও প্রাচীন কেন্দ্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম আগমনের প্রাক্কাল থেকেই এই অঞ্চলে একের পর এক আগমন ঘটেছে আল্লাহর বিশেষ বন্ধুদের আউলিয়া কেরামের, যাঁরা শুধু দাওয়াতের দিশারি ছিলেন না, বরং ছিলেন মানবিক মূল্যবোধ, তাযকিয়া ও ইসলামী সংস্কৃতির জীবন্ত মূর্ত প্রতীক।

চট্টগ্রামের পাহাড়, নদী ও বন্দরঘেঁষা এই ভূখণ্ড বহু যুগ ধরে জাগতিক অন্ধকারে দীপ্ত করেছে আধ্যাত্মিক নূরের বাতিঘর হয়ে। ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে এখানে আগমন করেন বহু সুফি দরবেশ ও ওলিআল্লাহ, যেমন: হযরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.), বদর শাহ ( রোহঃ), জঙ্গি শাহ (রহ.), হযরত শাহ সুফি মুমিন (রাহ.) এবং সর্বোপরি হযরত শাহ সুফী আমানত খাঁ (রাহ.) যিনি চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম।

জন্ম ও পরিচয় : হযরত শাহ সুফী আমানত খান (রহ.)এর জন্মস্থান সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছু মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, তিনি পাঞ্জাব বা ভারতের কোনো অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি ইসলামের দাওয়াত ও তাসাওফের সাধনায় বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামে আগমন করেন। অনেকে তাঁকে কুতুবচট্টগ্রাম আখ্যা দেন, যার মানে হলো চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক নেতা।

তিনি ছিলেন একজন খাঁটি আল্লাহওয়ালা, যিনি নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে সমাজে ইসলামের দাওয়াত, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিশেষত চট্টগ্রামের মানুষ তাঁর আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যে যুগ যুগ ধরে আলোকিত হয়ে আসছে।

চট্টগ্রামে আগমন : শাহ আমানত খান (রহ.) চট্টগ্রামে আগমনের পর কর্ণফুলী নদীর তীরে বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের বুকে একটি নির্জন স্থানে বাস করেন। তিনি তখন একজন দরবেশ, নির্লোভ, নির্জনভক্ত মানুষ হিসেবে সাধারণের নজরে আসেন। দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি ইবাদত, মুরাকাবা ও জিকিরে মশগুল থাকতেন।

তরীকত অনুসরণে : হযরত শাহ আমানত খান (রাহঃ)-এর তরীকতের অনুসরণে ঐতিহাসিক ও সুফি গবেষক একমত যে, তিনি ছিলেন কাদিরিয়া তরীকতের একজন সাধক। কাদিরিয়া তরীকা সুফিবাদের প্রাচীন ও প্রভাবশালী একটি শাখা, যার প্রবর্তক হলেন হযরত আবদুল কাদির জীলানী (রাহঃ)। এই তরীকায় তাওহিদ, খলাস (নিঃস্বার্থতা), রিয়াজত ও নফসকে দমন করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের সুফি ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, উপমহাদেশে আগত বহু আউলিয়া, বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলে যাঁরা আসন গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে কাদিরিয়া তরীকতের প্রচার ও চর্চা ছিল ব্যাপক। হযরত শাহ আমানত (রাহঃ)-এর জীবনাচরণ, তাঁর প্রকাশ্য জাহিরি দুনিয়া থেকে আত্মগোপনতা এবং চুপচাপ আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ কাদিরিয়া তরীকার চিহ্ন বহন করে।

একজন শহর কুতুব পরিচয়ে : একজন শহর কুতুব পরিচয়ে তাঁর পরিচয় তুলে ধরার পূর্বে কুতুবিয়তের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আমাদের সবার কাছে জানা দরকার। ইসলামি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে ‘কুতুব’ শব্দটির অর্থ হলো আধ্যাত্মিক মহাবিন্দু বা কেন্দ্র, যিনি আল্লাহর হুকুমে সমগ্র জগতে আধ্যাত্মিক ভারসাম্য ও রহমতের ধারাকে পরিচালনা করেন।

সুলূকের ভাষায় কুতুব হলেন এমন এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যিনি সময়ের মধ্যমণি আলকুতুব আলআকতাব। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রতিটি সময়েই একজন ‘কুতুব’ থাকেন, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের পাত্র এবং উম্মতের জন্য আধ্যাত্মিক আশ্রয়।

হযরত শাহ সুফী আমানত খান (রাহ.)-এর জীবন, তার নিঃশব্দ কর্ম, আত্মগোপন সাধনা এবং আধ্যাত্মিক প্রভাবের যে ব্যাপকতা, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি চট্টগ্রাম শহরের ‘শহর কুতুব’ ছিলেন। তাঁর মাজার শরীফ যেন চট্টগ্রামের আধ্যাত্মিক মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল দিশারী। একান্ত নীরবে তিনি শত সহস্র মানুষের অন্তরকে জাগ্রত করেছেন, অদৃশ্যভাবে রুহানি প্রভাব বিস্তার করেছেন।

সাধারণের প্রতি ভালোবাসা ও সমাজ সংস্কারে তাঁর দর্শন : হযরত শাহ আমানত খান (রহ.) সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতেন। তিনি মানুষকে নামাজ, রোজা, তাকওয়া, দানশীলতা ও ইনসাফের প্রতি আহ্‌বান জানাতেন। অনেক দুনিয়াপ্রেমিক তাঁর সংস্পর্শে এসে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে নেককার হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মজলিসে বিভিন্ন ধর্মবর্ণের লোকও এসে আধ্যাত্মিক শান্তি লাভ করত।

আত্মউপলব্ধি ও জীবনে প্রভাব : হযরত শাহ আমানত খান (রাহঃ)-এর দরবারে জিয়ারত আমার জীবনে একটি অনন্য উপলব্ধির দ্বার খুলে দেয়। তাঁর মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হয়এই মহাপুরুষ আল্লাহর দিকে ধাবিত হবার যে পথ দেখিয়ে গেছেন, তা কেবল বিগত কোনো কালের জন্য নয়, আজও সেই পথ জীবন্ত, বাস্তব ও পরিপূর্ণভাবে প্রযোজ্য।

তাঁর জীবনযাপন, দুনিয়ার প্রতি নির্লিপ্ততা, আধ্যাত্মিক আত্মনিবেদন, সব মিলিয়ে এমন এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও দয়া শেখায়, যা মানুষকে মানুষ হতে সাহায্য করে। তাঁর দরবার থেকে ফিরে আসার পর আমি অনুভব করি, অন্তরে এক ধরনের ভারসাম্য এসেছে চিন্তাচেতনায় নম্রতা, আচরণে সংযম, এবং জীবনের প্রতিটি বিষয়ে এক ধরণের শুদ্ধতার সন্ধান শুরু হয়েছে। আল্লাহর এ মহান আওলিয়ার মাজার জিয়ারতের পর যেন অন্তরে এক অদৃশ্য প্রতিজ্ঞা জন্ম নেয় এই চিন্তায় যে, জীবনে যতটুকু সম্ভব, অন্যের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেব। কারণ শাহ আমানত খান (রাহঃ)-এর শিক্ষা শুধু পাথেয় নয়, তা এক ধরনের মিশন, যা হৃদয়ে ধারণ করলে ব্যক্তি জীবনের সকল স্তরে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আত্মোপলব্ধির এক অপূর্ব বাস্তবতা সৃষ্টি হয়।

আমি তাঁর কাছে কোনো জাগতিক চাওয়া নিয়ে যাই না তবুও ফিরে আসি ভরপুর এক প্রশান্তি, সংযম, ও হৃদয়ের আলো নিয়ে। এই আলো আমার ব্যক্তিগত জীবন, কর্মজীবন ও সম্পর্কের জগতে নতুন আভা যোগ করে। আর এই জন্যই আমার কাছে হযরত শাহ আমানত খান (রাহঃ) শুধু চট্টগ্রামের এক অলৌকিক সাধক নন তিনি আমার আত্মিক জাগরণের এক নীরব পথপ্রদর্শক।

শিক্ষণীয় দিক : শাহ আমানত খান (রহ.) আমাদের শিক্ষা দেন আত্মিক উন্নয়ন ও আল্লাহর সন্তুষ্টিই জীবনের মূল লক্ষ্য। তিনি দেখিয়েছেন যে, প্রকৃত মুসলমান হতে হলে শুধু বাহ্যিক রীতিনীতিই নয়, বরং হৃদয়ের ভেতর তাকওয়া ও আল্লাহভীতি থাকা আবশ্যক। দুনিয়ার মোহ থেকে দূরে থেকে ইবাদত ও মানুষের সেবাই ছিল তাঁর জীবনের মূল উদ্দেশ্য।

পরিশেষে বলা যায়, হযরত শাহ সুফী আমানত খান (রহ.) ছিলেন এক অনন্য রিয়াজতকারী, যিনি চট্টগ্রামে ইসলামের আধ্যাত্মিক আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর জীবন ছিল এক জীবন্ত দাওয়াত, এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নিদর্শন। আজকের সমাজে যদি শাহ আমানত (রহ.)-এর মতো চরিত্রবান, আল্লাহভীরু মানুষ সৃষ্টি হয়, তাহলে আমাদের সমাজ শান্তি, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ হবে। আমরা তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হই এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতি ও মানবজীবনে রবি ও চন্দ্রের প্রভাব
পরবর্তী নিবন্ধসৌদি অধ্যায়ের ইতি টানছেন রোনালদো