শাহ আমানত সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টের ত্রুটি ২৪ মাসেও সারায়নি সওজ

ঝুঁকিতে থাকা সেতুতে রাম্বল স্ট্রিপস

কর্ণফুলী প্রতিনিধি | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৫:০৮ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত শাহ আমানত সেতুর (নতুন ব্রিজ) দক্ষিণ প্রান্তের এক্সপানশন জয়েন্টে দুই বছর আগে ত্রুটি ধরা পড়লেও গত ২৪ মাসেও তা সারানোর কোন পদক্ষেপ নেয়নি চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ।

এরমধ্যে সাধারণ যাত্রীদের চোখে এক্সপানশন জয়েন্টের ত্রুটি আরো স্পষ্টভাবে বড় দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। ফলে, বাড়ছে ঝুঁকি আর সেতু নিয়ে নানা শঙ্কা। যদিও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৮টি উপজেলা, পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও পর্যটন নগরী কক্সবাজার তথা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যোগাযোগের একমাত্র সেতুবন্ধন হলো শাহ আমানত তৃতীয় সেতু।

কোন কারণে দক্ষিণ প্রান্তের এক্সপানশন জয়েন্টে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ব্যাহত হবে। যদিও বিকল্প হিসেবে কর্ণফুলী টানেল কে ভাবা হয়, সেটা হবে অনেক ব্যয়বহুল আর উল্টোপথ।

তথ্য পাওয়া যায়, গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে জটিলতা তৈরি হওয়া এ সেতুর ত্রুটি ও ঝুঁকি চিহ্নিত করতে ঢাকাস্থ চীনের কিছু প্রকৌশলীরা সেতু পরিদর্শন করেন। তাঁরা সে সময় সেতুর ত্রুটি ও ঝুঁকি চিহ্নিত করে পরামর্শ দেন দক্ষিণ প্রান্তে রাম্বল স্ট্রিপস (গতিরোধক) বসানোর।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ দুর্ঘটনা এড়াতে তাই বসিয়েছিলেন। কিন্তু গত ২৪ মাসেও সংস্কার করা করেনি।

রাম্বল স্ট্রিপস স্লিপার লাইন বা অ্যালার্ট স্ট্রিপ নামেও পরিচিত। যা অমনোযোগী চালকদের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য, একটি স্পর্শকাতর অস্পষ্ট কম্পন এবং গাড়ির অভ্যন্তরে চাকার মাধ্যমে শ্রবণযোগ্য গর্জন সৃষ্টি করে। এ সেতুর উপর পারাপারের সময় সব ধরনের গাড়ির গতি বেড়ে যায়। মূলত গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে আপাতত গতিরোধক বসানো হয়েছে।

এছাড়াও অতি শিগগিরই যদি শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণপ্রান্তে এক্সপানশন জয়েন্টে স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেয়া না হয়। তবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যোগাযোগে হঠাৎ বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। সেতুটির নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) এ বিষয়ে তড়িৎ ব্যবস্থা ও আরো সচেতন হওয়ার দরকার রয়েছে বলে মনে করেন যাত্রী ও চালকরা।

এদিকে, শাহ আমানত সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে স্পিড রাম্বল স্ট্রিপস (গতিরোধক) বসানোয় সেতু থেকে নামার সময় দক্ষিণ চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারগামী যানবাহনের জটলা তৈরি হয়েছে। তার উপর ঈদে ঘর মুখো মানুষের চাপ।

এছাড়াও, সেতুতে রাম্বল স্ট্রিপস স্থাপন করার কারণে বাস কিংবা পণ্যবাহী ভারী যানবাহন কে ব্রেক চাপতে হয়। কেননা, গতিরোধক থাকায় যানবাহনের গতি বেশি থাকলেও তা নিজের নিয়ন্ত্রণে নামাতে হয়। এ সময় তীব্র ঝাঁকুনি তৈরি হয়। এর ফলে, সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বাইকার, বয়স্ক যাত্রী ও প্রসূতি নারীদের।

শাহ আমানত সেতু টোল প্লাজার পরিচালক (অপারেশন) অপূর্ব সাহা মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও ফোনের সংযোগ পাওয়া যায়নি। তবে টোল প্লাজার ইজারাদার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কোম্পানি ইউডিসি-ভ্যান জেভি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার সুমন ঘোষ বলেন, ‘দক্ষিণ প্রান্তে সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে ত্রুটির বিষয়টি জেনে ঢাকা থেকে একটি সার্ভে টিম এসে দেখে গেছেন। এরপর আর কেউ এসেছে কিনা আমার জানা নেই।’

এছাড়াও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিতের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে,
শাহ আমানত সেতুর দুই পিলারের নিচ বরাবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশ থেকে ক্রমাগত মাটি সরে গিয়ে গভীরতা স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে পিলারগুলো দেবে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সেতুর জন্যও।

তবে সেতু নির্মাণকারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই পিলারের নিচ থেকে মাটি কিছুটা সরলেও এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

সড়ক ও জনপথ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি আমাদের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর সাথে কথা বলতে পারেন। উনার কাছে তথ্য পাবেন।’

সড়ক ও জনপথ চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘প্রধানত অস্ট্রেলিয়ান কোন বিশেষজ্ঞ টিম এটি পরিদর্শন করেনি। এটি পরিদর্শন করেছেন ঢাকাতে আমাদের আওতায়ধীন একটা প্রজেক্টের কিছু চীনের কনসালটেন্ট এসেছিলেন। আর সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টের বর্তমান পরিস্থিতি আমরা লিখিত ভাবে আমাদের উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি।’

গত দুই বছরে ত্রুটি সংস্কারে সওজ কি ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আরো বলেন,’ সেতুর ত্রুটি বিষয়ে সার্ভে করা হয়েছে। সবকিছু নোট নেওয়া হয়েছে। ছবিসহ ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। সেতুর জয়েন্টের অবস্থা ভালো বলব না। তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনেকদুর এগিয়েছে ফাইল। আপাতত আমরা সেতুতে রাম্বল স্ট্রিপস স্থাপন করেছি।’

কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু হেনা মোহাম্মদ তারেক ইকবাল জানিয়েছিলেন ‘মূলত সেতুর এক্সপানশন জয়েন্টে কারিগরি জটিলতা তৈরি হয়েছে।’ চীনা প্রযুক্তিতে ১০০ বছরের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে নির্মিত সেতুটি ২০১০ সালে উদ্বোধনের ১১ বছর না যেতেই এই ধরনের ত্রুটি ঝরা পড়ে।

জানা যায়, ২০০৬ সালের ১৯ এপ্রিল তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১০ সালে। ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর উদ্বোধন করেন। ওই বছরেই সেতুটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেতুটি চালুর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়

সওজ সূত্রে জানা গেছে, শাহ আমানত সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার ও প্রস্থ ২৪ দশমিক ৪৭ মিটার। এ সেতুটি ক্যাবল স্ট্যান্ড এক্সট্রা ডোজ কংক্রিট সেতু। চারলেন, ফুটপাত ও ডিভাইডারসহ সেতুর মূল দৈর্ঘ্য ৮৩০ মিটার।

সেতুর মোট পিলার সংখ্যা ১০টি। এরমধ্যে নদীর মাঝখানে চারটি, সেতুর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছয়টি। চার লেনবিশিষ্ট এ সেতুটির সংযোগ সড়কও সমান প্রশস্ত। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি সেতুটি নির্মাণ করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে নিহত ১
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ চট্টগ্রামের ৬০ গ্রামে ঈদুল আজহা কাল