শাহীনুর সরোয়ার : মঞ্চের আলোর এক অমল দীপ

পায়েল বিশ্বাস | সোমবার , ১৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের চন্দনপুরার এক শান্ত গলি, ১৯৫৭ সালের কোনও একদিন। মোহাম্মদ নাজিরের ঘরে জন্ম নিল এক ছেলেশিশু সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়, নাম শাহীনুর সরোয়ার। ছোটবেলা থেকেই তাঁরই টান রূপ নিল দৃশ্যমান এক আকর্ষণে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর, ১৯৭২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর-‘জাগরণ সংঘ’ ক্লাবের আয়োজনে প্রথমবার মঞ্চে পা রাখেন তিনি। সেদিন ছিল কেবল শুরু, কিন্তু সেই শুরুতেই জন্ম নিল এক আজীবনের প্রতিশ্রুতি শিল্পের অমল আলো বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রতিশ্রুতি।

মঞ্চ থেকে জীবন, জীবন থেকে মঞ্চ: ১৯৮০ সালে তিনি ‘প্রতিনিধি নাট্য সমপ্রদায়’ প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন, গ্রুপ থিয়েটারের ধারায় নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেন। জীবিকার জন্য ছোটখাটো ব্যবসা করতেন, কিন্তু মঞ্চ ছিল তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন। পরিবারও ছিলেন এই যাত্রার সঙ্গী, স্ত্রী ও দুই কন্যা নাটকের পোশাক ধোয়া, ইস্ত্রি করা থেকে শুরু করে মঞ্চসংক্রান্ত সবকিছুতে ছিলেন তাঁর অবিচ্ছেদ্য সহযোদ্ধা।

স্বাধীনতার ২৫ বছর পূর্তিতে এক অনুষ্ঠানে মেকআপ শিল্পী না পাওয়ায় নিজেই মেকআপ করলেন এটাই ছিল তাঁর শিল্পজীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। পরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কর্মশালায় অংশ নিয়ে হয়ে ওঠেন একজন পেশাদার মেকআপ আর্টিস্ট। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর এই দক্ষতার স্বীকৃতি মিলেছিল। ঢাকার বড় শিল্পীরাও যেখানে আটকে যেতেন, সেখানে তিনি অনায়াসে সমাধান বের করতেন অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বের করতেন নিজস্ব ‘টোটকা’। গত তিন দশকে বাংলাদেশ মঞ্চের খুব কম মুখ আছে যাদের গায়ে তাঁর তুলি লাগেনি।

চরিত্রের ভেতরে ডুবে যাওয়া অভিনেতা শাহীনুর সরোয়ার ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি প্রতিটি চরিত্রের খুঁটিনাটি নোট করতেন, নিজস্বভাবে স্ক্রিপ্ট ব্রেকডাউন করতেন, আর চেষ্টা করতেন চরিত্রকে বাস্তব করে তুলতে। তিনি নিজ দলের নাটক ছাড়াও অভিনয় করেছেন অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়, শব্দ নাট্য চর্চা কেন্দ্র, নাট্যাধার, জেলা শিল্পকলা একাডেমি রেপারটরি নাট্য দলসহ বহু সংগঠনের প্রযোজনায়।

মঞ্চ ছাড়াও তিনি যুক্ত ছিলেন কমার্শিয়াল থিয়েটারের সঙ্গে, আবার সমান দক্ষতায় অভিনয় করেছেন টেলিভিশন নাটক ও শর্ট ফিল্মে। নব্বইয়ের দশকে হুমায়ুন ফরীদি স্যার তাঁর সহশিল্পী হয়ে তাঁকে ঢাকায় চলে আসার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন প্রদীপ দেওয়ানজী রচিত এবং আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত অয়নের জবানবন্দী নাটকে।

পরিচালক শাহীনুর সরোয়ার: শুধু অভিনয় নয়, তিনি ছিলেন দক্ষ নাট্যনির্দেশকও। শের শাহ কলোনিতে রূপালী নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে নাটক পরিচালনা করেছেন। নিজ দলের প্রযোজনা হিসেবে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রদীপ দেওয়ানজী রচিত রাকস নাটকে। অরিন্দম নাট্য সমপ্রদায়ের হয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন খেঁকশিয়াল পথ নাটকে। ভিজুয়াল মাধ্যম দৃশ্যছায়ার হয়ে যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন শর্ট ফিকশন বাড়ি ভাড়া।

কাজের তালিকা:

চলচ্চিত্র : হালদা ( পরিচালনা: তৌকির আহমেদ), বলি (পরিচালনা: ইকবাল হোসেন), উখিনু (পরিচালনা: ইফতেখার আহমদ সায়মন)

টেলিফিল্ম : পুনশ্চ: (পরিচালনা: অরিন্দম মুখার্জি বিংকু), সেকেন্ড এপ্রিল (পরিচালনা: আশরাফুল করিম সৌরভ), জান্নাত (পরিচালনা: আশরাফুল করিম সৌরভ), অতঃপর দুজন (পরিচালনা: আশরাফুল করিম সৌরভ)

মঞ্চনাটক : উর্নাজাল : নান্দীমুখ প্রযোজনা, উচ্চতর গণিত, অনুতপ্ত।

শর্টফিল্ম ও বিশেষ কাজ : ফান (নির্মাণ : রফিকুল আনোয়ার রাসেল), অনাকাঙ্ক্ষিত ( নির্মাণ: ইফতেখার আহমদ সায়মন), পতাকা (নির্মাণ: ইফতেখার আহমদ সায়মন), স্বপ্নের শিখরে হলুদ কোলাজ (নির্মাণ: মোরশেদ হিমাদ্রি হিমু), একটি খুনের বিবরণ (নির্মাণ: মোরশেদ হিমাদ্রি হিমু), দীর্ঘশ্বাস (পরিচালনা: বড়ুয়া সীমান্ত)

আন্তর্জাতিক শর্টফিল্ম প্রোডাকশনে প্রোটাগনিস্ট (শিমলা, কঙ্কণ দাস ও অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে)

বিজ্ঞাপন: রবি (পরিচালনা: রেদওয়ান রনি), টি ক্যাশ (পরিচালনা: মোকাদ্দেম মোরশেদ)

ন ডরাই’ রোল ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা: মঞ্চের প্রতি তাঁর নিবেদন এতটাই গভীর ছিল যে, সময়ের অভাবে ন ডরাই সিনেমার একটি চরিত্র ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেননি। পরবর্তীতে সিনেমাটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র হয়। তবুও তিনি সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেনকারণ সেই সময় তিনি মঞ্চের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন।

সামাজিক বার্তাবাহী শেষ কাজ: তাঁর জীবনের শেষ পূর্ণাঙ্গ কাজ ছিল আকার ইকার চলচ্চিত্র নিবেদিত টেলিফিল্ম জান্নাত বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে মাতৃত্বের করুণ পরিণতি নিয়ে।

শেষ দিন পর্যন্ত অভিনয়ের ভেতর: ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বরউখিনু সিনেমার শুটিং চলাকালীন সময়েই শুটিং স্পটে মারা যান তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন তাঁর ভালোবাসার জায়গায়মঞ্চ ও অভিনয়ের ভেতরে।

শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন ডিরেক্টরস আর্টিস্টজাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালককে যেমন সম্মান দিতেন, তেমনি সদ্য কাজ শুরু করা তরুণ নির্মাতাকেও সমান মর্যাদা দিতেন।

ব্যক্তিগত জীবন: স্ত্রী ও দুই মেয়ের ভালোবাসায় ঘেরা। কন্যাদ্বয়ই বিবাহিতদুই নাতি রয়েছে; একজন জন্মেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়, আরেকজনের জন্ম হয় মৃত্যুর পর। নিজের দুই বোনকেও তিনি সবসময় নিজের কাছে রাখতেন, যার মধ্যে এক বোনের ঘরে দুই সন্তান ছিল। সংসার ও মঞ্চদুই জগতকেই তিনি সমান উষ্ণতায় আঁকড়ে রেখেছিলেন।

প্রজন্মের জন্য বার্তা: তিনি বিশ্বাস করতেন, নাটক শেখা মানে ধৈর্য, অনুশীলন ও আত্মসমর্পণ। শেষ দিনগুলোতে তিনি আক্ষেপ করতেনআজকের প্রজন্ম দ্রুত মিডিয়ার আলো চায়, কিন্তু শিল্পের গভীর শিকড় ধরতে চায় না।

শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রযোজনায় : শাহীনুর সরোয়ার ১১টি প্রযোজনায় ২০০এর বেশি প্রদর্শনী করেছেন দেশবিদেশে। নাটকগুলো: ঠিকানা, ছায়াবৃতা, নানকার পালা, দর্পণ সাক্ষী, ইনফরমার, কন্যাদান, রাইফেল, ক্যাম্প, যুদ্ধ স্বাধীনতা, চম্পাবতী, কীচাহ শঙ্খচিল। ইষ্টিকুটুম প্রযোজনায় মনভালো চশমা। ভারতবর্ষে ১৭৫টির বেশি শো করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, দিল্লী, ত্রিপুরা, রাজকোট, চেন্নাই, ভূপালএবং অন্যান্য স্থানে জনপ্রিয় ছিলেন। মৃত্যুর ১৫ দিন আগেও শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটক কীচাহ শঙ্খচিল ঢাকায় মঞ্চায়ন করেছেনএটাই তাঁর মঞ্চে শেষ শো।

শ্রদ্ধাঞ্জলি : শাহীনুর সরোয়ার স্যার, আপনি শুধু একজন অভিনেতা বা মেকআপ আর্টিস্ট ছিলেন না আপনি ছিলেন মঞ্চের এক উজ্জ্বল প্রদীপ। আপনার মঞ্চযাত্রা, আপনার শ্রম, আপনার ভালোবাসাসবকিছু আজও থিয়েটারের বাতাসে ভাসে। আলো নিভে গেলেও করতালির প্রতিধ্বনি যেন আজও শোনা যায়, আপনার নাম উচ্চারণ করে।

আপনার প্রস্থান শুধু একজন শিল্পীর মৃত্যু নয়, এটি চট্টগ্রামের মঞ্চজগতের এক ইতিহাসের অবসান। তবু আপনি রয়ে গেছেনমঞ্চের আলোয়, প্রজন্মের স্মৃতিতে, আর সেইসব চরিত্রের ভেতরে, যেগুলোকে আপনি প্রাণ দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র: আশরাফুল করিম সৌরভ সংরক্ষিত সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণ : ইফতেখার আহমদ সায়মন, কংকন দাশ, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রধান খোরশেদুল আলম খোরশেদ। লেখক : কবি, সংস্কৃতিকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভুলভাল নেই কোনখানে
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর টয়লেটের প্রতি কেন এত অবহেলা