শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) তিন আধ্যাত্মিক মহা মনীষীর আশীর্বাদপুষ্ট এক মহান অলি। তিনি সূফি মতবাদের ধারক ও মহান মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার প্রবর্তক হযরত গাউসুল আ’যম মাওলানা শাহ্সূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর প্রপৌত্র, মুর্শিদে কামেল খাদেমুল ফোকরা হযরত মাওলানা শাহ্সূফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর জ্যেষ্ঠপুত্র।
শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর মহান অলির মর্যাদা প্রাপ্তির পশ্চাতে রয়েছে কঠোর রিয়াজত সাধনা। তিনি প্রচণ্ড শীতের রাতে দিনের পর দিন পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে ডুবে থেকেছেন, গরমের দিনে গরম কাপড়ের এক গাদা স্তূপ হয়ত বা গায়ে জড়িয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন থেকেছেন, একাধারে ১০/১২ দিন আহার–নিদ্রা ছাড়া কালাতিপাত করেছেন, কয়েক শতাধিক ভোল্টের ক্ষমতাবিশিষ্ট ইলেকট্রিক শক খেয়ে নীরব থেকেছেন, কখনও বা খালি পায়ে কন্কনে শীতের মধ্যে মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করেছেন। এভাবে সীমাহীন রিয়াজত ও কঠোর সাধনার মাধ্যমে এ মহাপুরুষ কামালিয়তের সর্বশ্রেষ্ঠ মোকাম অর্জনে ধন্য হয়েছিলেন। সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে ৪০ বৎসর বয়সে হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর স্বপ্নাদেশক্রমে খাদেমুল ফোক্রা হযরত দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর সবুজ টিয়া রঙের জুব্বাখানি শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) কে পরিয়ে দেন এবং এর মাধ্যমে তিনি বেলায়তে ওজমার অধিকারী হন ও অলিদের সর্বশ্রেষ্ঠ মোকামে সমাসীন হন। অনেক বেছালপ্রাপ্ত অলি স্বপ্নযোগে তাঁর এ মহান মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি স্বীয় যুগের বিভিন্ন অলি–আল্লাহ্দের সাথে প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখা–সাক্ষাৎ করেছেন এবং ইশারা–ইঙ্গিতে কথাবার্তা বলেছেন। তিনি বিভিন্ন অলির মাজারে গিয়েছেন এবং জেয়ারত করেছেন। তাঁর কামালিয়াত ও বুজুর্গী সম্পর্কে কারও কোন দ্বিমত নেই। ওলামায়ে কেরাম ও পীর মাশায়েখবৃন্দ তাঁকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন। বিভিন্ন অবস্থা ও সময়ে তাঁর অসংখ্য কারামতের প্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন সময়ে ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি বিভিন্ন বাণী উচ্চারণ করেছেন। বিশ্বের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে তাঁর কারামতসমূহ এবং মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তাঁর মহান বাণীসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী।
শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের উপর আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্রষ্টা ও রসূল (দঃ)-এর প্রতি তাঁর মহান ও স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্যের ফলে। শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)এর জীবনের প্রধান সাধনাগুলো হচ্ছে–
স্রষ্টার সাধনা: স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির মিলনই হচ্ছে সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। স্রষ্টাকে পেতে হলে স্রষ্টার আরাধনা করতে হবে। কারণ স্রষ্টার ইবাদতের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব; যেহেতু ইবাদত বা স্রষ্টার আরাধনা হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সংযোগ তথা সেতু বন্ধনের প্রধান চাবিকাঠি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কোন রুগ্ন ব্যক্তি শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর নিকট দোয়া চাইতে গেলে তিনি প্রায়শঃ তাকে নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিতেন। ইসলামের প্রধান স্তম্ভ সালাত বা নামাজ কায়েম করার জন্য তাঁর ছিল কঠোর নির্দেশ। তিনি বলতেন, “নামাজ আল্লাহর হেকমত। নামাজ না পড়লে হেকমতের ক্ষতি হয়।” তিনি আরও বলেন, “হালাল খাও, নামাজ পড়, আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকির কর। সব সমস্যা মিটে যাবে।”
নির্বিলাস জীবনের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)অযথা ভোগ–বিলাসকে পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন, “টাকা সম্পত্তি প্রয়োজনীয় খরচের জন্য, কারো ভোগ বিলাসের জন্য নয়। বেশি টাকা–পয়সা জীবনকে কলুষিত করে, আল্লাহ্র সম্পর্ক ভুলিয়ে রাখে। আল্লাহ্র প্রতিনিধিত্বের জন্য মানুষের সৃষ্টি, টাকা কড়ি দুনিয়া পূজার জন্য মানুষের সৃষ্টি নয়।”
বিশ্ব প্রেমিকের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)একজন মহান মানব প্রেমিক। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানবতার জন্য তাঁর ছিল সীমাহীন দরদ ও মমত্ববোধ।
ধৈর্যের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)ধীরে চলার নীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং বিপদে আপদে খোদার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধরার জন্য উপদেশ দিতেন।
সত্যের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)ছিলেন সততা, সরলতা ও সত্যবাদিতার জ্বলন্ত প্রতীক। তাঁকে জীবনে কোনদিন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে দেখিনি। তিনি মানুষকে ভুল ও ভ্রান্তি থেকে সত্যের দিকে টেনে তোলার জন্য আগমন করেছিলেন।
জ্ঞান অর্জনের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিটি মানুষকে উপদেশ দিতেন এবং জ্ঞানী লোককে অত্যধিক সমাদর করতেন। বর্তমান বিশ্ব বিশেষতঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিচার বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, প্রধানতঃ ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার কারণেই আজ প্রায় অঞ্চলে দুর্নীতির বন্যা ও চরিত্রহীনতার করাল গ্রাস জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
হালাল রুজির সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) হালাল রুজির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। তিনি বলতেন, “হালাল খাও, নামাজ পড়, আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকির কর, সব সমস্যা মিটে যাবে।” তিনি অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনকে ঘৃণা করতেন। তিনি বলতেন, “অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ কলুষিত। হালাল রুজির পথ ইচ্ছে করে বন্ধ করা অনুচিৎ।”
কর্মের সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)কর্মে বিশ্বাস করতেন, আলস্যে নয়। তিনি বলতেন, “কাজের জন্য জগৎ–জীবন ও আল্লাহ্–রসূলের বিধান। ভালো কাজও ইবাদত। অলস হয়ে বেকার বসে থেকো না।” বস্তুতপৃথিবীতে আজ যে সকল জাতি সাফল্যের শ্রেষ্ঠ সোপানে আরোহণ করেছে, তাদের সে সাফল্যের মূলে রয়েছে কর্ম ও নিষ্ঠা।
সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের সাধনা: ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নীতিতে তিনি ছিলেন অটল। তাঁর কাছে উচ্চ–নিচ, আশরাফ–আতরাফ এরূপ কোনও তফাৎ ছিল না। তিনি বলতেন, “আল্লাহ্র অলির দরবারে আমির–ফকিরের কোনও তফাৎ নেই।”
কল্যাণকামী শাসন ব্যবস্থার সাধনা: তিনি কল্যাণকামী রাষ্ট্র ও সরকারি শাসন ব্যবস্থা নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি বলতেন, “জনগণ সরকারের সন্তানতুল্য। সন্তানের শান্তিতে যেমন মাতা–পিতার শান্তি, তেমনি জনগণের সুখ শান্তিতেই সরকারের শান্তি।”
আত্ম–সমালোচনার সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)আত্ম–সমালোচনার জন্য মানুষকে উপদেশ দিতেন। বস্তুতঃ আত্ম–সমালোচনার দ্বারা আত্ম–বিশ্লেষণের ফলে মানুষের মনের কালিমা বিদূরিত হয় এবং আত্মা পরিশুদ্ধ ও পবিত্র হয়, আত্মার উপলব্ধি জাগ্রত হয়। “নিজের ভেতরে দৃষ্টি দাও, বহির্জগতের চেয়েও অপরূপ সুন্দর দৃশ্যাবলী দেখতে পাবে।”–এই ছিল তাঁর বাণী। বলা বাহুল্য, আত্ম–সমালোচনা হচ্ছে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের সপ্ত পদ্ধতির একটি বিশেষ অঙ্গ।
বুদ্ধি ও বিজ্ঞান চর্চার সাধনা : বুদ্ধি ও বিজ্ঞান চর্চার উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে চলার জন্য উপদেশ দিতেন। বুদ্ধি বা বিবেক আছে বলেই আজ মানুষ আশরাফুল মখলুকাত, সৃষ্টির সেরা। বিজ্ঞান ও বুদ্ধির বলেই বিশ্বের অনেক কঠিন কাজ সহজতর হয়েছে। বিভিন্ন জাতি এত কাছাকাছি আসতে পেরেছে। আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান বা কৌশলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তিনি বলতেন, “কৌশলে কঠোর কঠিন কাজও সহজে করা যায়।”
মাইজভাণ্ডারী দর্শন চর্চার সাধনা: শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) হলেন মাইজভাণ্ডারী দর্শনের অন্যতম ধারক ও বিকাশকারী। সূর্য চিরভাস্বর, যেরূপ সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে তেজোদীপ্ত আলো ছড়িয়ে দেয়, হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)ও সেরূপ স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন।
শাহানশাহ্ হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)-এর বহুমুখী জীবন সাধনার বিভিন্ন দিকসমূহ এত বেশি ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী যে তা এ স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। আমি আলোচ্য প্রবন্ধে তাঁর জীবন সাধনার বিশেষ কয়েকটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। আল্লাহ্তালা আমাদের সকলকে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের সঠিক অনুশীলন করার তওফিক দিন। আমিন!
লেখক : শিক্ষাবিদ











