আল্লাহ রাব্বুর আলামিন পথভ্রষ্ট মানব জাতিকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী–রাসুল এ ধরাধামে প্রেরণ করেছেন। নবী –রাসূলগণের প্রতিনিধিত্বের ধারাবাহিকতায় তাঁদেরই কর্মসূচি প্রচার–প্রসারের জন্য গাউছ, কুতুব, অলি, আবদাল, আওতাদ, পীর–মাশায়েখ, ওলামায়েকেরাম এ ধরণীতে তশরিফ এনে দ্বীন ও মিল্লাতের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এমন অসংখ্য অলি–বুজর্গ আবির্ভূত হয়ে দ্বীন ও মিল্লাতের কার্যাদি সম্পন্ন করেছেন। আমরা তাঁদের নিকট চিরঋণী হয়ে আছি। যেসব ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তির অসাধারণ মেধা ও দ্বীন মাযহাবের প্রচার সত্য প্রতিষ্ঠায় বহুমুখী অবদান রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে শাইখুল ইসলাম শাহসুফী আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন আল–ফারুকী (ক.) অন্যতম। তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, বহু প্রতিভার অধিকারী, বহুগুণে গুণান্বিত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।
বংশ পরিচয়: হযরত শাহসুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুক (ক.) হলেন একজন রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র বংশধর। ঐতিহাসিকের মতে, ১১৭৫–৭৬ সালে সৈয়দ বংশের কেউ কেউ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে গৌড় নগর থেকে হিজরত করে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে আগমন করেন। এখানে তাঁরা ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর মধ্যে দুইজন বোয়ালখালী থানার হাওলা গ্রামে তশরিফ আনেন। সেই খ্যাতিনামা বুজুর্গ ছিলেন, যথা–হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ কুতুব (ক.) ও হযরত শাহ্সুফি মারুফ শাহ্ (ক.) এ বংশের পরম্পরায় হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ আইন উদ্দীন (ক.) তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে ১ম শাহাজাদা হযরত শাহ্সুফি মাওলানা ছানাউল্লাহ (ক.), মেজ শাহাজাদা হযরত শাহ্সুফি আহছান উল্লাহ (ক.), সেজ শাহাজাদা হযরত শাহ্সুফি মাওলানা আব্দুল করিম (ক.)। উল্লেখ্য যে, তাঁর মেজ শাহাজাদা সৈয়দ আহসান উল্লাহর কোন ওয়ারিশ বর্তমান নেই। ১ম শাহাজাদা শাহ্সুফি মাওলানা ছানা উল্লাহ (ক.)’র একজন ছেলে সন্তান ও দুই জন কন্যা সন্তান ছিলেন। ছেলে সন্তান হচ্ছেন অলিয়ে কামেল কুতুবে জমান শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ্সুফি সৈয়দ মঈজুদ্দীন (ক.) ও দুই বোন শাহজাদি সৈয়দা করিমুন্নেছা (ক.) ও শাহজাদি সৈয়দা রহিমুন্নেছা (ক.)। হযরতের এই দুই বোন অল্প সময়ে ইন্তেকাল করেন। বোনদের ইন্তেকাল পরপর হযরতের আব্বাজান শাহসুফি সৈয়দ ছানাউল্লাহ (ক.) ও সেজ চাচা আল্লামা সৈয়দ আব্দুল করিম (ক.) এর সাথে সফর সঙ্গী হয়ে উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার অন্তর্গত গুমানমর্দ্দন গ্রামে কাটাখালীকুল সৈয়দ বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
শুভ জন্মগ্রহণ শৈশবকাল ও শিক্ষা জীবন: হযরত শাহ্সুফি আল্লামা মঈজুদ্দীন (ক.) ১২৪৩ হিজরী মোতাবেক ৫ মাঘ ১২৩২ বাংলা এবং ১১ মে ১৮২৫ খ্রি. রোজ বৃহস্পতিবার সুবেহ সাদিকের সময় এই পৃথিবীতে শুভাগমন করেন।
আধ্যাত্মিক জগতের দ্বীপ্তিমান নক্ষত্র হযরত শাহছুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন আল–ফারুকী (ক.) ‘বড় মাওলানা’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি শৈশব হতে তাঁর মার্জিত ব্যবহার, আচার–আচরণ এবং চাল চলনের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ শিশু অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়ে মানবতার সেবা ও আল্লাহ ও রাসুলের প্রেমের আদর্শ হবেন। সল্প সময়ের মধ্যে তিনি এলমে শরীয়ত তথা কুর’আন–হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, বালাগাত ও মানতিক বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তৎসময়ে চট্টগ্রামে উচ্চ শিক্ষা যা ছিল তা শেষ করে তিনি আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য সকলের সহযোগিতায় ১২৫৯ হিজরিতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তিনি সকল শ্রেণিতে কৃতিত্বের সাথে প্রথম স্থান অর্জন করে ১২৬৭ হিজরি সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে সমাজ, দেশ ও জাতির খেদমতে ছড়িয়ে পড়েন।
ত্বরিক্বা গ্রহণ ও খেলাফত অর্জন: হযরত শাহসুফি সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) বাল্যকাল থেকে সুফি দরবশ ও আলেম ওলামাগণকে ভক্তি করতেন ও তাদের সেবা সুযোগ পেলে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতেন। তিনি শরীয়তের গভীর জ্ঞানী হিসেবে অসংখ্য আলেম–ওলামা পথের দিশারী হিসাবে তাঁর নিকট আসতেন। তিনি হযরত বড় পীর ইমামুত তরিক্বত গাউছুল আযম সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (ক.) বংশধর, যিনি কাদেরিয়া তরিকতের একজন বড় বুজুর্গ ছিলেন যাঁর পবিত্র নাম সরদারে আউলিয়া হযরত আবু শাহমা মুহাম্মদ সালেহ লাহোরী (ক.) এর দরবারে পৌঁছে কাদেরিয়া তরিকার উপর তাঁর নূরানি হাতে বাই’আত গ্রহণ করে নিজেকে লাহোরী (ক.) দরবারে সোপর্দ করে দিলেন এবং তাঁর খেদমতে রয়ে গেলেন। পরে তিনি পীরের ছোহবতে থেকে খেলাফত ও বেলায়ত অর্জন করেন।
সংসার জীবন: হযরত শাহসুফি আল্লামা সৈয়দ মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত বক্তপুর গ্রামের মাওলানা মোহছেন আলী শাহ এর কন্যার সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন। উক্ত সংসারে তাঁদের কোন ছেলে–মেয়ে হয়নি পরে তিনি ছিপাতলী গ্রাম থেকে দ্বিতীয় বিবাহ করেন, সে সংসারে তাঁর ছেলেমেয়ে রয়েছে তৎমধ্যে শাহজাদা শাহ্সুফি আল্লামা সৈয়দ ইদ্রিছ (ক.) অন্যতম।
কর্ম জীবন: শাহসুফি হযরত আল্লামা ছৈয়দ মঈজুদ্দিন আল ফারুকী (ক.) কলকাতা আলিয়া থেকে টাইটেলের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরপরই উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসাবে খেদমতে যোগদান করে অনন্য খেদমতের আনজাম দেন, পরে তিনি মুর্শিদের আদেশে ‘মদিনাতুল আউলিয়ার’ (অলি আল্লাহদের শহর) পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানায় নিজ গ্রামে চলে আসেন। কিছু দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আপন চাচার সাথে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত গুমানমর্দন গ্রামে হিজরত করে বসবাস করেন। তাঁরই নামে ‘সৈয়দ পাড়া’ প্রসিদ্ধ হন। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ‘ফকির মুহাম্মদ জামে মসজিদে’ মহান ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি হেদায়তে কর্মেও আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন স্থানে অগণিত আলেমেদ্বীন ও সাধারণ মানুষকে তিনি দ্বীনি শিক্ষা দানের হেদায়তের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন।
হযরতের অসংখ্য মুরিদ ও যোগ্য খলিফা ও বিদগ্ধ পণ্ডিত ছাত্ররা আজ দেশ বিদেশে শরীয়ত তরিকতের খেদমত আনজাম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শরীয়ত তরিকতের অনেক লিখিত কিতাব রয়েছে। তৎমধ্যে: ফতোয়ায়ে লাবুদ্দিয়া অন্যতম। আরো অনেক কিতাব অযত্নে কিছু নষ্ট হয়ে গেছে আর কিছু পাণ্ডুলিপি আকারে রয়েছে।
শাহসূফি মাওলানা ছৈয়দ মঈজুদ্দিন আল ফারুকী (রহ.)’র বেছাল শরিফ ও জানাজার ইমামতি: ইন্তেকালের কিছুদিন পূর্বে তিনি ভক্ত–মুরিদ সকলকে ডেকে কিছু নসিহত করেন এবং বলেন আমার ওফাতের পর তোমরা আমাকে কফিন পড়িয়ে জানাজার জন্য তৈরি করবে। আমার জানাজার নামাজ তোমাদের মধ্যে কেউ পড়াতে হবে না। সবাই জিজ্ঞেস করলেন হুজুর জানাজার নামাজ ছাড়াই কি দাফন করব? তিনি প্রতিউত্তরে বললেন, না। যখন জানাজার নামাজের জন্য তোমরা তৈরি হবে তখন পশ্চিম দিক থেকে এক ব্যক্তি আসবে তাঁর মাথায় থাকবে পাগড়ি, তিনি এসেই আমার জানাজার নামাজ পড়িয়ে দিবেন। এ উপদেশ দেওয়ার কিছু দিন পর তিনি বেছাল হন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ ৩ রমজান ১৬ মাঘ মোতাবেক এ নশ্বর জগতে সকল ভক্ত মুরিদানের জন্য অশেষ করুণার দ্বার উন্মুক্ত করে প্রেমাস্পদের সান্নিধ্যে তশরিফ গ্রহণ করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
পবিত্র কাফন পরিধান করে তাঁর লাশ মুবারক জানাযার মাঠে নেওয়ার পর পরই তাঁর ভবিষ্যত বাণী মতে, পশ্চিম দিক হতে এক আল্লাহর অলি এসে সামনে দাঁড়ায় জানাযার ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। এ অবস্থা দেখে সবাই আশ্চর্য হলেন। তাঁর পবিত্র মাজারের পার্শ্বে জানাযার ইমাম সাহেব চারদিন পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। তিনি কোনও মানুষের সাথে চার দিনের মধ্যে কোনও প্রকার কথা বলেননি এবং পানীয় ব্যতীত কিছু আহার করেননি। চারদিন পর তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হযরতের হাজার হাজার কেরামত জনশ্রুতিতে রয়েছে। আমি আমার লিখিত তাঁহার জীবনীতে অনেকগুলো কেরামত লিপিবদ্ধ করেছি।
ওরশ শরীফের সূচনা: হযরত শাহসুফি সৈয়দ আল্লামা মঈজুদ্দীন (ক.) এর ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ওফাতের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওরশ শরীফ জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হত না। পারিবারিকভাবে যার যেখানে ইচ্ছা বার্ষিক ফাতেহা করত। আনুষ্ঠানিক ভাবে সূচনা হয় আমার শ্রদ্ধেয় দাদাজান হযরত মাওলানা সৈয়দ আমিনুল হক (রহ.) এর সময় কাল থেকে। তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবাই মুখে মুখে বলতে লাগল তিনি হয়তো আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে যাবেন। দাদাজান এক রাত্রি বেলায় স্বপ্নে দেখেন যে, এক বুজর্গ ব্যক্তি সুন্দর আকৃতির লোক এসে বললেন, তুমি একটি দাওয়াত শরীফের আয়োজন কর, তুমি ভালো হয়ে যাবে, আমার (লিখকের) দাদা হযরতের কন্যা শাহজাদি সৈয়দা জোবেদা খাতুনকে পরদিন ডেকে তাহাকে স্বপ্নের কথাগুলো বললেন। হযরতের কন্যা বললেন তুমি যার কথা বলেছ তিনিতো আমার আব্বাজান হযরত শাহ্সুফি সৈয়দ আল্লামা মঈজুদ্দীন (ক.)। ঠিক তাঁর কথা মতো দাদাজান দাওয়াতের আয়োজন করলেন দাওয়াত শুরু হয়ে গেল, দাওয়াতের পর আমার দাদাজান বললেন, আমাকে একটু দাঁড় করিয়ে দাও। দাওয়াত শেষ হওয়ার পরই দাদাজান পুরাপুরি সুস্থ হয়ে যায়। তিনি সেই বছর থেকে হযরত শাহসুফি সৈয়দ আল্লামা মঈজুদ্দীন (ক.)’র ওফাত তারিখ অনুযায়ী বার্ষিক ওরশ শরীফ ১৯৫৩ সাল থেকে আরম্ভ করেন। যা আজ পর্যন্ত চলে এসেছে।
শেষ কথা: যুগপৎ শরীয়ত তরিকতের ধারক–বাহক আল্লামা মঈজুদ্দীন ফারুকী (ক.) জীবদ্দশায় ইলমে শরীয়তের জ্ঞান–চর্চা, ছাত্রদের মাঝে বিতরণ, অসংখ্য কুরআন, হাদিসের প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা, সমাজ সংস্কার মূলক বিবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: অধ্যক্ষ, ওয়াছিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা।