চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র ছাত্রী, অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ শাহনাজ কামরুন নাহারের মরদেহ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যাওয়ার আলোচিত ঘটনায় নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা রুজু হয়েছে। মামলায় গৃহবধূ শাহনাজ কামরুন নাহারের (২৫) স্বামীসহ ৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা দায়েরের ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে হাটহাজারী থেকে ওই গৃহবধূর এক ননদের স্বামী এবং দুই ননদসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। দুইজনের পছন্দকে সম্মান দিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হলেও বিয়ের পর থেকেই শ্বশুরবাড়িতে স্বামী এবং তার স্বজনেরা যৌতুকের জন্য নিয়মিত শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল বলে গৃহবধূ শাহনাজ কামরুন নাহারের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, পটিয়ার হাইদগাঁও এলাকার মোহাম্মদ মুনির আহমদের কন্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র ছাত্রী শাহনাজ কামরুন নাহারের সাথে পটিয়ার বেলখাইন এলাকার সামশুল আলম সওদাগর বাড়ির মৃত মোহাম্মদ রফিকুল আলম চৌধুরীর পুত্র পাথর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আল ফায়াদ চৌধুরীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা পরিবার পরিজন নিয়ে নগরীর কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার ৫ নম্বর সড়কে কাইয়ুম রেসিডেন্সের চতুর্থ তলায় বসবাস করেন।
দুজনের প্রেমের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর দুই পরিবার ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দেয়। ইতোমধ্যে সন্তানসম্ভবা হন শাহনাজ। আর মাত্র ১০/১২দিন পরই তার প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আসার কথা। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। শাহনাজের নিথর দেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ঘটনার ব্যাপারে গত বুধবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন ভিকটিম শাহনাজের বড় ভাই মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, নিহত শাহনাজের শাশুড়ি চেমন আরা রফিক (৬৪), শাহনাজের স্বামীর বড় বোন তাসলিমা আফরোজ (৪৪) ও তার স্বামী মো. লোকমান (৪২), শাহনাজের স্বামীর মেজো বোন খাদিজা আফরোজ (৩৭), স্বামীর সেজো বোন তাহমিনা আফরোজ (৩২) এবং স্বামীর ছোট বোন নাজিফা সালসাবিন (৩০)।
ভিকটিম শাহনাজের ভাই মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার বোনের সঙ্গে আল ফায়াদ চৌধুরীর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। এরপর থেকেই বিভিন্ন সময় তার স্বামী যৌতুক দাবি করতেন। ভুক্তভোগী শাহনাজ ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকায় অনাগত সন্তান ও নিজ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি সব নির্যাতন সহ্য করে সংসার করছিলেন। ধীরে ধীরে তার ওপর নির্যাতনের চাপ আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত ১৬ অক্টোবর রাত দেড়টার দিকে শাহনাজের শাশুড়ি ফোন করে বাদীর স্ত্রীকে জানান, তার বোন অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। বাদী বিষয়টি জানতে পেরে ঢাকা থেকে বিবাদীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কেউ রিসিভ করেননি।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাদী তার স্ত্রীর মাধ্যমে জানতে পারেন তার বোনকে চট্টগ্রামের বেসরকারি ন্যাশনাল হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই হাসপাতালে তাকে ভর্তি না করায় পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক বাদীর বোনকে মৃত ঘোষণা করেন এবং মৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ‘লিগ্যাচার মার্ক অ্যারাউন্ড নেক’। এরপর তার বোনের মরদেহ সেখানে ফেলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান বিবাদীরা। বাদীর ধারণা বিবাদীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং প্ররোচনার কারণে তার বোন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
গতরাতে দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে মামলার বাদী শাহনেওয়াজ বলেন, আমার বোনের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রাণচঞ্চল বোনটির এভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছি না। তারা আমার বোনকে বিয়ের পর থেকে নানাভাবে নির্যাতন করে আসছিল। আমরা তাদেরকে যৌতুক হিসেবে টিভি, ফ্রিজ, আসবাবপত্রসহ নানা কিছু দিয়েছি। তাদেরকে খুশি করার জন্য আমরা সবসময় চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমরা যেটাই দিই না কেন, সেটা তাদের পছন্দ হয় না। এগুলো নিয়ে সবসময় আমার বোনকে খোঁটা দেওয়া হতো। মানসিক নির্যাতন করা হতো। পান থেকে চুন খসলেই তার গায়ে হাত তুলতো। ঘরের ছোটখাটো কাজেও ভুল ধরে অত্যাচার করতো। আমার বোনের সঙ্গে ওইদিন রাত ১টা পর্যন্ত আমি নিজেই কথা বলেছি। এর আগে তার স্বামী আমাকে কল দিয়ে বিচার দিয়েছে। আমি বোনের সঙ্গে কথা বলার আধাঘণ্টা পর রাত দেড়টার দিকে তার শাশুড়ি আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন যে আমার বোন অজ্ঞান হয়ে গেছে।’ বিষয়টি রহস্যজনক, এটা স্রেফ মার্ডার। আমার বোনকে তারা নির্যাতন করে হত্যা করেছে।
এই ব্যাপারে পাঁচলাইশ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলাইমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, মামলাটিকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। মামলা দায়েরের মাত্র ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে আমরা এজাহারনামীয় তিনজনকে হাটহাজারী থেকে গ্রেপ্তার করে এনেছি। মামলার বাকি আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেন, মেয়েটা ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। তাকে তার স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো বলে শুনেছি। যার দরুণ সে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। মূলত আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগেই মামলাটি করেছেন তার ভাই।
পুলিশ অভিযান চালিয়ে গৃহবধূ শাহনাজ কামরুন নাহারের স্বামীর বড় বোন তসলিমা আফরোজ (৪০) এবং তার স্বামী মোহাম্মদ লোকমান, জামালখান মোড়ের সন্নিকটস্থ সলিমা সিরাজ মহিলা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার বিপরীত পাশের আফফান কমপ্লেঙের বাসিন্দাকে হাটহাজারী পৌরসভার মীরের হাটস্থ দুলা মিয়া সওদাগরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। একই সাথে ভিকটিমের অপর ননদ নাজিফা সালসাবিনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি নগরীর কসমোপলিটন আবাসিক এলাকার ৫নং রোডের ৪০ নম্বর বাড়ির (কাইয়ুম রেসিডেন্স) চতুর্থ তলায় বসবাস করেন। মামলার এজাহারনামীয় অপরাপর পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও পাঁচলাইশ থানা পুলিশ জানিয়েছে।