শারদীয় দুর্গোৎসব

ছন্দা চক্রবর্তী | বৃহস্পতিবার , ২ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

সনাতন শাস্ত্র মতে দুর্গা পূজা, প্রকৃতির পূজা, শক্তির পূজা, মিলিত শক্তির আরাধনা। এই বিশ্ব চরাচর এর সব কিছু একটি মহাশক্তির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত, যে শক্তি সব শুভ শক্তিকে উৎপন্ন করে, রক্ষা করে। সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদগীতার তথ্য মতে, প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই সত্তার সম্মিলিত রূপ হচ্ছে বিশ্বব্রম্মান্ড। পুরুষ মানে পুরুষোত্তম ভগবান এক ও অদ্বিতীয়। সেই অদ্বিতীয় শক্তির ইচ্ছায় প্রকৃতিতে সৃষ্টির বীজ নিক্ষিপ্ত হয়,আর তখনিই পরমা প্রকৃতির সৃষ্টি। পরমা প্রকৃতির মিলিত শক্তির রূপই দুর্গা, শিবা, চণ্ডী, ক্ষমাধাত্রী, জগত জননী, মা দুর্গা ছাড়াও আরও নানা কার্যকরণের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নামে খ্যাত।

দুর্গাপূজার বিধান সাধারণত বাঙালি হিন্দুদের কাছেই প্রচলিত। সনাতন ধর্মের নানা জায়গার মানুষের কাছে নানা নামে যেমন নবদুর্গা, নবরাত্রি, ইত্যাদি রূপে জগতজননী মা দুর্গা পূজার প্রচলন রয়েছে। দুর্গা পূজা আসলে ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর এক উপায়, কেননা প্রকৃতির সব ক্ষুদ্র উপকরণ থেকে, আরম্ভ করে বড়ছোট, উঁচু নিচু, ধনী গরীব এমনকি পবিত্র গঙ্গাজল আবার পতিতালয়ের মাটি পর্যন্ত পূজার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ যেন সকলের অংশকে এবং সকলকে মায়ের মতো ছুঁয়ে দেখা সার্ব্জনীন প্রক্রিয়া ছাড়াও সকলকে একসাথে মিলিত করে একসূত্রে বেঁধে রাখারও প্রক্রিয়া। দুর্গাপূজা প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিকে তাকালে বোঝা যায় এখানে নারীপূরুষের সমদৃষ্টি ভাবটাও ফুটে উঠে। ধূপ দীপফুলফল নৈবেদ্যাদি দিয়ে পূজা স্থুল ব্যাপার, এর পিছনে রয়েছে পৌরাণিক আখ্যান ও সুক্ষ্ম মিলনের দর্শন। ষষ্টির বোধন থেকে শুরু করে দশমীর বিসর্জন পর্যন্ত ক্রিয়াবহুল নানা ধাপের পূজার এক একটি অংশ এক একটি উদ্দ্যেশ্যে তাৎপর্যমণ্ডিত।

দুর্গাপুজোতে মা দেবী দুর্গাকে নয়টি প্রকৃতির উপাদানকে অবলম্বন করে নয়টি বৃক্ষকে প্রতীক হিসেবে নিয়ে নয়টি রূপের প্রকাশ নবপত্রিকা বা কলাবউ নামে দেবী দুর্গার সাথে পূজিত হয়। গণেশের ডান পাশে এর অবস্থান নির্ধারিত থাকে। নব পত্রিকার উপাদান সমূহ হলো যথাক্রমে দেবীর ১. ব্রহ্মাণী রূপ কলাগাছ, . লক্ষ্মী রূপধানগাছ, . চামুন্ডা রূপমানকচু, .শিবা রূপবেল, . রক্তদন্তিকা রূপডালিম,. উমা রূপহলুদ,.কালিকা রূপকচু, .কার্ত্তিকী রূপজয়ন্তী, . শোকরহিতা রূপঅশোক, এই নয়টি প্রকৃতির অংশকে সাদা অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে একসাথে নবপত্রিকা বা কলাবউ রূপে স্নান করিয়ে পণ্ডিত ও বুদ্ধির দেবতা গনেশের পাশে পূজিত হয়। আর এর মাধ্যমে সাধারণ ভক্তবৃন্দ বা উপাসকদেরকেও সকলে সম্মিলিত ভাবে থাকার অন্তর্নিহিত মেসেজ থাকে এবং প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ব্যাপারটা স্মরণ করা হয়। এখানে খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে প্রকৃতির উপাদান সমূহের মধ্যে একে অপরের সাথে যুক্ত। কোন সৃষ্টিই মা দুর্গার আশীর্বাদের বাইরে নয়, তা দেখানো হয়। মহান পূজা দুর্গা পূজার পাঁচ দিনের প্রত্যেকটি অংশের প্রত্যেকটি নিয়ম এক একটি উদ্দ্যেশ্যে সমাজের শুভ কাজের জন্য করা হয়ে থাকে।

দুর্গাপুজো বারোয়ারী পুজো, সকলের মিলিত পুজো, কেউ দুর্গা পুজোকে এককভাবে করতে চাইলে তা করতে পারা যায় না, করার বিধানও নেই, যেমন কেউ চাইলো, অমনি লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো একটা মূর্তি নিয়ে এসে এই পূজা করা যায় না, এটি একটি মহাযজ্ঞ, অনেক পরিকল্পনা, অনেক মানুষের সম্পৃক্ততা করতে হয়, বহুজনের মিলনে, সকলের শুভকামনায়, ‘বহুজন হিতায় চঃ বহুজন সুখায়’এই উদ্দ্যেশ্যে এই মহতী পুজোর আয়োজন হয়। সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা একেশ্বর ভগবানের মিলিতশক্তির সত্তাকে পুরাণ আখ্যান অনুযায়ী মূর্ত করে তোলেন মূর্তি গড়ে, যা শাস্ত্রে আছ্‌ে, সেই শক্তির মূর্ত প্রতীক মূর্তি। ঐ মুর্তিতে মন্ত্র দ্বারা প্রাণ সঞ্চার করে গড়ে তুলেন প্রতিমা। প্রতিমা মানে এতে বিরাজিত থাকে প্রতিটি মা। যে মা সংসারের দশদিক সামলান তাই তো তিনি দশভূজা। আর দেবী দুর্গার প্রতিটি মায়ের মাল্টি টাস্কিং ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে রয়েছে দশভূজার দশ হাত, এ সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের ব্যাখ্যাটা খুবই প্রাসঙ্গিক—‘কাঠ মাটি দিয়ে গড়া /মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরি /হয়ে যায় আত্মহারা।’

মূলত শ্রী শ্রী চণ্ডীর বিধান অনুযায়ী দুর্গাদেবী পূজিত হয়। সনাতন ধর্মের মূলধর্মগ্রন্থ বেদ থেকেই সমস্ত পূরাণ, উপনিষদ ও যাবতীয় ধর্মগ্রন্থাদি সৃষ্টি হয়েছে। সেসব সৃষ্ট ১৮ খানা পুরাণের মধ্যে মার্কন্ডেয়পুরাণের ৮১তম৯৩তম এই ত্রয়োদশ অধ্যায় সমূহে শ্রীশ্রী চন্ডীর আখ্যান বর্ণিত রয়েছে যা সাধারণের কাছে ‘শ্রী শ্রী চন্ডী’ নামে পরিচিত । মার্কন্ডেয় পুরাণে এই অংশের নাম দেওয়া হয়েছে ‘দেবীমাহাত্ম্য’। সপ্তশত মন্ত্র এখানে আছে বলে, এর আরেক নাম ‘সপ্তশতী’। এই সপ্তশতীতে সকল শক্তির আধারভূতা, সেই মহাশক্তি স্বরূপীনি দেবী দুর্গার আরাধনা, পূজা, আর মাহাত্ম্যকথা রয়েছে। বিপদ্মুক্ত হওয়া, সম্পদ, যশ ইত্যাদি কাম্যবস্তু লাভ, কীভাবে কোন সাধনায় সেই শক্তিররূপিণী মহা দেবীকে তুষ্ট করে রাজা সুরথ, অক্ষয় সম্পদ লাভ আর সমাধি বৈশ্য মোক্ষ লাভ করেন তার বিধান বর্ণিত আছে। পূরাণ মতে দেবরাজ ইন্দ্র দেবীদুর্গা কে সংবর্ধিত করে হারানো রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। দুষ্টু রাবণকে বধ ও শ্রীরামচন্দ্রকে অসুর বধে দুষ্টূর দমনে অনুগৃহীত করে ব্রহ্মাদিসহ অন্য দেবতারা অকাল বোধনের মাধ্যমে শরতকালে দেবীর পূজা করেছিলেন যা শারদীয়া দুর্গোৎসব নামে পরিচিত এবং প্রচলিত। প্রকৃতপক্ষে বসন্তকালে বাসন্তী পূজা হিসেবে দুর্গা দেবীর পূজাই বিধেয়। কিন্তু বাঙালী হিন্দুদের কাছে এখন শারদীয়া পূজাই প্রধান পূজা যা দুর্গোৎসব নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

যেহেতু গ্রাম থেকেই পুজোর প্রচলন শুরু হয়েছে তাই দুর্গাপুজোর প্রধান আকর্ষণ বাদ্য বাজনা। এই বাদ্যবাজনার মধ্যে ঢাক বাজানো বা ঢাকের বাড়ি দিয়েই শুরু করা হয়। পুজোকে উৎসবে পরিণত করতে ঢাকের বাড়ি তুলনাবিহীন। কারণ প্রাচীন কালে ঢাকের গমগমে আওয়াজ গ্রামের আনাচ কানাচে পৌঁছে যেত বলে সর্বাধিক লোকের সম্মেলন ঘটানোর জন্যও ঢাক অপরিহার্য থাকতো। পূরানের কথিত বর্ণনা রূপে পাওয়া যায় মহিষাসুরের সাথে যখন শ্রী শ্রী চন্ডীর সাথে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন শুভ শক্তির প্রচার সংবাদের জন্য বা দেবী দুর্গার আগমনী সংবাদ প্রচারের জন্য ‘ঢঙ্কানিনাদ’ নামে একটি যন্ত্র বেজে উঠেছিল, যা পরবর্তীতে অপভ্রংশ হয়ে ঢাক নাম ধারণ করে। আমাদের এই বাংলাদেশে এই বিশাল আকৃতির এবং খুব ভারী গমগমে আওয়াজের যন্ত্রটির প্রাপ্যতা অধিক ছিল, ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে ঢাকার নামের সাথে ঢাক প্রাপ্যতার যোগসূত্র আছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। পুজোতে ঢাকের বাজনা ঐতিহাসিক কাল থেকেই চলমান। রবীন্দ্রনাথ ছোটদের কবিতা ‘পূজার সাজ’ এ লিখেছেন ‘আশ্বিনের মাঝামাঝি / উঠিল বাজনা বাজি, / পূজার সময় এল কাছে। মধু বিধু দুই ভাই /ছুটাছুটি করে তাই,/আনন্দে দু হাত তুলি নাচে।’ শরতের সাদা মেঘের ভেলা, আর ঢাকের গমগমে বাজনা মানেই দুর্গা দেবীর পূজার সময়, এভাবেই চলছে কালের পর কাল যেন মহামিলনের আনন্দকাল।

দুর্গা পুজো মহৎ পুজো আর পুজো মানেই উৎসব। প্রকৃতির রূপ যেন এসময়টাতে সর্বোচ্চ সৌন্দর্য প্রদান করে থাকে, তাই উৎসব ব্যাপারটা আরো ঘনীভূত হয়ে মানুষের অন্তরে একটা উৎসবভাব বিরাজ করে। দেবী দুর্গা সেই উৎসব ভাবকে আধার করে মহা আনন্দকে ছড়িয়ে দিয়ে মহা উৎসবে পরিণত করে তোলেন, যা সর্বসাধারণের কাছে হয়ে উঠে শারদীয়া দুর্গোৎসব। উৎসবকে রবীন্দ্রনাথ ব্যাখা করেছেন এভাবে,‘সংসারে প্রতিদিন আমরা সত্যকে স্বার্থের বিক্ষিপ্ততায় ভুলে থাকি, উৎসবের বিশেষ দিনে সেই অখণ্ড সত্যকে উপলব্ধির দিন, স্বীকার করার দিন, কারণ, উৎসব মানুষকে পরস্পরের সাথে পরস্পরের মিলন ঘটায়’। পূজা উদযাপনে সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হউক। শ্রীশ্রী চন্ডী থেকে নেওয়া এই শ্লোকটি বেশি প্রয়োজনা দেবী র্স্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা। / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ। ২২/৫ শ্রী শ্রী চন্ডী। অর্থ ; যে দেবী সমস্ত জীবের মধ্যে বুদ্ধি রূপে অবস্থান করছেন, তাঁকে বার বার নমষ্কার, যেন শুভ বোধ আমরা লালন করতে পারি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষহুলাইন ছালেহনূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্ব শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় পরাশক্তিসমূহ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম বাঙালি মুসলিম নারী কবি রহিমুন্নেচা