শামসুন্নাহার রহমান পরাণ : সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

অনগ্রসর নারী ও শিশুদের কল্যাণ এবং দেশ গঠনে তৃণমূল পর্যায়ে সেবার জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন এবং সমাজকে আলোকিত করেছেন ও নিজেও আলোকিত হয়েছেন সেরূপ এক মহীয়সী নারী চট্টগ্রামের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ঘাসফুল’ এর প্রতিষ্ঠাতা শামসুন্নাহার রহমান পরাণ। সমাজ ও নারী উন্নয়ন এবং নানামুখী জনকল্যাণমূলক কাজের সুবাদে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের নিকট তিনি ‘পরাণ আপা’ নামে সমধিক পরিচিত।

আর্তমানবতাকে নিয়ে কাজ করা তৃণমূল ও অনগ্রসের জনপদে কাজ করে যাওয়া মহীয়সী এ নারীকে নিয়ে আজকের লেখা। ১৯৪০ এর ১ জুন চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারের বাটালী রোডের মাতুলালয় ‘মায়া কুটিরে’ তাঁর জন্ম। মা সাজেদা খাতুন এবং বাবা মৌলভী আমির হোসেন মজুমদার। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দিঘি ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত সুফি পরিবারের সন্তান তিনি।

শামসুন্নাহার পরাণ অপর্ণাচরণ বালিকা বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক এবং একই স্কুলের উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। সে কালের নিয়মানুযায়ি স্কুল জীবনে বিয়ে হয়ে গেলেও পড়ালেখা ছেড়ে দেননি। তিনি চার সন্তান নিয়ে প্রাইভেটে মেট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে কিছুকাল এম. এ পড়ার সময়ে সিন্ডিকেটের ছাত্র প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন এর সেডপা (সিইডিপিএ) থেকে ডিপ্লোমা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনহপিকন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাবলিক হেলথ’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রি অর্জনের জন্য বৃত্তি লাভ করলেও ছোট ছোট সন্তানাদির কথা বিবেচনা করে উচ্চশিক্ষার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে বাধ্য হন। তাঁর স্বামী এম. লুৎফর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান আয়কর উপদেষ্টা।

মা সাজেদা খাতুন অল্পবয়সে ইন্তেকাল করেন। এগার ভাইবোনের মধ্যে পরাণ ছিলেন সকলের বড়। তিনি যখন মা মারা যান তখন ছোট বোনের বয়স মাত্র চার বছর। মায়ের মৃত্যুর পর দশ ভাইবোনকে তিনি মায়ের স্নেহে বড় করেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অল্পবয়সে মায়ের মৃত্যুতে মনে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে তাঁর। মূলত একারণেই তিনি মাতৃমৃত্যু রোধ সহ অসহায় নির্যাতিত আর্তমানবতার সেবা করার প্রেরণা লাভ করেন। মেয়েরা জন্মের পর হতেই যে বৈষম্যের শিকার তিনি মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করেন।

ষাটের দশকে তিনি চট্টগ্রাম বেতারে ছোটদের জন্য ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। পরাণ বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে স্বাধীন দেশ গঠনে স্বপ্রণোদিত হয়ে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। সমাজসেবা এবং অনগ্রসর নারী সমাজের উন্নয়নের মহা ব্রত নিয়ে তিনি সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চট্টগ্রামে ‘ঘাসফুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘ঘাসফুল’ এর মাধ্যমে শামসুন্নাহার পরাণ সমাজে অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে বিশেষ করে দরিদ্র, লাঞ্ছিত নারী এবং ক্ষুধার্থশিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে কাজ শুরু করেন। যুদ্ধবিধ্বস্থ বাংলাদেশে পাহাড়সম প্রতিকূলতার মাঝে ‘ঘাসফুল’ নিভৃতে নীরবে সেবামূলক কাজ করে গেছেন। চট্টগ্রাম শহরের বস্তিতে বস্তিতে তিনি কাজ করেছেন। তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টার ফলস্বরূপ শামসুন্নাহার পরাণের নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন লাভ করেন এবং চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম রেজিস্টার্ড এনজিওর মর্যদা পান। সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের জীবনজীবিকার মান উন্নয়নে ঘাসফুলের কার্যক্রম দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শামসুন্নাহার পরাণের আন্তরিকতা একক কার্যক্রম ও প্রচেষ্টায় ‘ঘাসফুল’ দেশের বিভিন্ন বিভাগে এবং বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্মাননা লাভ করেন। শামসুন্নাহার পরাণ নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ঘাসফুলের লগোতে ছোট পরিবারের প্রতিক ব্যবহার করে সকল মহলে প্রশংসিত হন।

নব্বই এর দশকে পরাণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ঔষধ শিল্পের গবেষক ও আবিষ্কারক ডা. এলটন ক্যাসেল ও ভারতের ডা. বিরল মল্লিক এর সাথে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গবেষণাকর্ম পরিচালনায় একটি সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেন। তিনি নগরীর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসস্থল, সুইপার কলোনিগুলোতে (মেথর পট্টি) শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন পরম মমতায়।

২০০৫ সালে সরকারি পর্যায়ে স্কুল শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নন ফরমাল প্রাইমারী এডুকেশনের মাধ্যমে সুইপার কলোনিতে তিনি এককভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়েছেন। সাধারণ মানুষের কাছে অচ্ছুত সম্প্রদায় মেথরদের বাসায় বাসায় গিয়ে তিনি নিয়মিত সুখদুখের খবর নিতেন এবং তাদেরকে নিজ বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। এ মেথর পট্টির বাসিন্দা ‘অবিরাম দাশ’ পরাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করে প্রকৌশলী হয়েছেন।

১৯৯৫ সালে ‘নারীর চোখে বিশ্ব’ এ প্রতিপাদ্য নিয়ে চীনের বেইজিং এ অনুষ্ঠিত নারী উন্নয়ন সম্মেলনে তিনি যোগদেন। নারী উন্নয়নের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করেছেন। যেখানে নারী নির্যাতনের সংবাদ পেয়েছেন সেখানে তিনি ছুটে গিয়েছেন। সাধ্যনুযায়ী সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নির্যাতিত, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা স্বামীহারা অসংখ্য অসহায় নারীদের তিনি ‘ঘাসফুলের’ বিভিন্ন সেক্টরে কাজের ব্যবস্থা করে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তিনি চট্টগ্রামের প্রায় শতাধিক দুস্থ মহিলাদের উন্নতমানের ধাত্রী প্রশিক্ষণ দিয়ে মহল্লায় মহল্লায় নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এতে করে এ সকল দুস্থ মহিলারা সমাজ উন্নয়নে অংশ গ্রহণ, নিজের আয়রোজগারের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও লাভ করবেন।

শামসুন্নাহার পরাণ সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের প্রথম দিকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রামের কোস্টাল অঞ্চলে বসবাসকারি তৃণমূল মহস্যজীবীদের উন্নয়নে ‘বেঅববেঙ্গল’ নামক এক প্রকল্পের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে জেলেদের মান উন্নয়নে কাজ করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি কখনোই এড়িয়ে যাননি তিনি। চট্টগ্রামসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিভিন্ন সংস্থা পরিচালনা এবং ক্ষেত্র বিশেষে অনেক ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯২ সালে ‘জাতীয় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল’ ও ‘সাউথ এন্ড সেন্ট্রাল এশিয়া রিজিওনাল কনফারেন্স অফ এডুকেশন ফর অল’ এর সদস্য সহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মাবোন ও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে তিনি প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামে ৭১ সালের নির্যাতিত এক কুলবধূ আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে হন্য হয়ে খুঁজেছেন এবং খুঁজেও পেয়েছেন। ৭১ এর বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি তাঁদের মর্যাদার জন্য এবং তাঁদেরকে সমাজে পুনর্বাসনের জন্য পত্র পত্রিকায় প্রচুর লিখেছেন। সমাজের নানা অনিয়ম দুর্ভোগ নির্যাতিত নারীদের কথা বলতে গিয়ে সেবার পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকে সমাজ সচেতনতা মূলক নিবন্ধের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন ছোট গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। তাঁর গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার কিংবা কবিতায় সমাজের নির্যাতিত নারী ও শিশুদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং উন্নয়নের আকুলতা ফুঠে উঠে।

শামসুন্নাহার পরাণ চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক পুরস্কার ও সংবর্ধিত হয়েছেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হলো, () উপলব্ধির আঙিনায়, () একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে, () পুষ্প পরাগ, () গল্প মঞ্জুরী, () তৃণমূলের অভিজ্ঞ রমণীগণ, () মুক্তিযুদ্ধের কথকতা, () আরশীতে সোনালী দহন, () সুবচন সংগ্রহ, () ছোটমণিদের বর্ণশব্দবাক্য শেখা, (১০) সৃজনেমননে, (১১) ছোটমণিদের লেখা শেখা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় জায়া (ত্রৈমাসিক), মর্মর (মাসিক), ঘাসফুল বার্তা (ত্রৈমাসিক), আমরা একঘর বাঙালি নামের বিভিন্ন প্রকাশনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।

সমাজকর্মী শামসুন্নাহার রহমান পরাণ শিক্ষকতা আর সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের হীরণ্ময় সময়গুলো। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি স্কুল এখনো তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ঘাসফুল’ প্রতিষ্ঠাতা, নারীনেত্রী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধে চেতনার অকৃত্রিম প্রেরণাদায়ীনি শামসুন্নাহার রহমান পরাণ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ খ্রি: দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তি দুনিয়ায় বইয়ের নতুন অনুষঙ্গ বুকটক
পরবর্তী নিবন্ধকবিতার পরিমাপ তার রহস্যে, তার লাবণ্যে এবং তার জাদুতে