৮০ দশকে রুমি ছিল অসম্ভব রকমের দুরন্ত এবং ডানপিটে এক কিশোর। সে সময় স্কুল পড়ুয়া এই তুখোড় মেধাবী রুমি দু’একটি ছড়া লিখেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ছড়াগুলো সেসময়ে ছাপা হয়েছিল দৈনিক পূর্বকোণ এর ‘কলরোল’ পাতায়। পাতাটি সম্পাদনা করতেন আজকের বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক আমার তৎকালীন সহকর্মী বিশ্বজিৎ চৌধুরী। রুমির পিতা ড. শামসুল আলম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন বিধায় বাংলা সাহিত্যের বড় বড় দিক্পালদের সাহচর্যেই রুমির বেড়ে ওঠা। ফলে সাহিত্যের সংস্পর্শ, লেখালেখির স্পৃহা, আঁকাআঁকির চর্চা সে রপ্ত করেছিল শিশুবেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠা কিশোরটি পিতার সহকর্র্মী এবং আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামান স্যারের একমাত্র কিশোরী কন্যা দোলার বাস দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুতে একটি ছড়া লিখে আমার কাছে নিয়ে আসে। ছড়াটির দু’একটি লাইন আমার মনে আছে। সে লিখেছিল ‘ দোলা নামের সেই মেয়েটি দুলিয়ে মাথার চুল, তুলবে না আর ফুল… ’ এমনি করেই শুরু ছড়াটিতে তাদের ক্যাম্পাসে খেলার সাথী দোলাকে হারিয়ে ফেলার মর্মস্পর্শী সব পঙ্ক্তি পড়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ছড়াটি সহকর্মী বন্ধু বিশ্বজিৎ চৌধুরীকে দিই। সে সেটি শিশু কিশোরদের জন্য নির্ধারিত পাতা ‘ কলরোল’ এ ছাপে। এরপরেই এলো বিশ্বকাপ ফুটবল। সে সময়ও রুমি আরেকটি ছড়া লিখে আমায় দেয়। ‘ সেটিরও কয়েকটি চরণ আমার মনে আছে। যেমন ‘ বক্সিং প্র্যাক্টিস চলে দিনরাত/ আমার ঘুষিতে আলী হয়ে যান কাৎ/তুখোড় নিয়াজ আসে দুপুরবেলা /আমাকে শিখিয়ে দেয় সে দাবাখেলা/” ।
আজ থেকে প্রায় চার দশকের কাছাকাছি সময়কার সেই ছড়া–লেখক রুমি এখন আমেরিকা প্রবাসী। এ–বছরের অমর একুশে বইমেলায় রুমির একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ‘জীবনের খেরোখাতা’। নামকরণ আমার যথার্থ মনে হয়েছে। কারণ, কবিতাগুলোতে লেখকের যাপিত জীবনের সঞ্চিত অনুভূতি ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা নানা বর্ণে নানা ছন্দে উৎসারিত হয়েছে। প্রেম, প্রকৃতি ছাড়াও মধ্যবিত্ত সমাজের নানান বঞ্চনা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাটল ট্রেন তো রয়েছে, সাথে বাইন্যা হাটের মন্দিরের শঙ্খ ধ্বণি আর পাথরঘাটার গীর্জার ঘণ্টার সাথে হালদা নদী, সর্তাখাল, নানীবাড়ির সুলতানপুর, প্রবাসজীবন, হাওয়াই জাহাজ, মায়ের প্রতিমূর্তির সাথে বাদ যায়নি গৃহকর্মী সুফিয়ার সংগ্রামী জীবনচিত্রও।
‘জীবনের খেরোখাতা’য় সর্বমোট ৪৮ টি কবিতা রয়েছে। শুরুর কবিতার নাম ‘মানুষ মেঘ ’। সে লিখেছে , ‘উড়ে চলা মেঘ, গোপন গন্তব্য থেকে ভেসে আসা মেঘ, তারও মন খারাপ হয়, ক্লান্ত দিনের শেষে তার ও ক্লান্ত মনে হয়, তবুও জিরোবার সময় নেই’ । পংক্তিটি পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠলো কালিদাশ আর মেঘদূত কাব্যের কথা। মেঘকে মানবায়িত করে রুমি তাঁর প্রথম কবিতায় কাব্যময়তার সূচনা করেন। তাঁর কবিতাগুলো পড়তে পড়তে কবি জীবনানন্দ দাশ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতায় প্রকৃতি, সমকালীন সমাজচিত্র ছাড়াও মানবজীবনের একেবারে তুচ্ছ ও সাধারণ ঘটনাকে কাব্যময় ব্যঞ্জনা দান করতে গিয়ে কবি যেন জীবনানন্দ দাশের কাছেই নতজানু হয়েছেন বারে বারে। ‘বাড়ি ফেরা পথ ’ কবিতায় কবি মায়ামীর সমুদ্রতট থেকে নিজবাড়ি চট্টগ্রামের আজাদীবাজার হয়ে তকিরহাটের স্মৃতিকে নানান চিত্রে ছন্দোবদ্ধ করে তুলেছেন।
‘কোনো এক আলো ঝলমলে দুপুর কিংবা নতমুখী বালিকার চোখের ভাষায় বিকেলের বিষন্ন আলোয় আজাদী বাজারের পথ ধরে মোহাম্মদ তকীর হাটের দিকে ফিরে যাওয়া হাটুরের দলের মতো। আমিও ফিরতে চাই, নতুন ওঠা আলু, ছোট বেগুন আর লইল্যা ইচা কিনে বাড়ি ফিরতে।’ এখানে যে ছোট বেগুনের কথা বলা হয়েছে , সেটি কিন্তু চাঁটাগাইয়াা ভাষায় বিখ্যাত (ডাবুয়া এলাকার ) ফুতা বেগুন, যা তকীর হাটের আশেপাশের এলাকায় কেবল চাষ হয়। এই গ্রন্থের প্রায় কবিতায় কবির নানান বয়সের বিচিত্র অভিজ্ঞতা কবিতার ছত্র হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
কিছু কিছু কবিতা দারুণ ছন্দে আদৃত। ‘ঝর্ণা এবং জলের গান’ তেমনই একটি কবিতা আবার ‘ মানুষ ছিলাম ’ কবিতায় “ জীবন খুঁড়ে যন্ত্রণা সব যত্নে লালন করি/ ঘড়ির মতো উঠছে নামছে, ছুটছে তড়িঘড়ি।/ আমার মতো ইচ্ছেগুলো লুকানো সংশয়ে / পথিক আমি পথ চলতে যাই কিছু তার ক্ষয়ে ” ।
গদ্য কবিতার পাশাপাশি এমন ছন্দোবদ্ধ চরণ হঠাৎ সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। আরেকটি কবিতার শিরোনাম ‘প্রতীক্ষা মানেই কি তবে প্রেম? ’ এই কবিতার একেবারেই শেষ চরণে রুমি বলেন. “গেলেও মনে রেখো’ অথচ আজকাল পুড়ছে বাগার দেয়া পেঁয়াজ রসুন, পুড়ে যাচ্ছে হৃদয়ের অলিগলি, পুড়ছে কবিতা। পুড়ে যাচ্ছে পরাজিত উষ্ণতা আর জীবনের খেরোখাতা। গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন লেখকের পিতা ড.মুহাম্মদ শামসুল আলম। এইটা পিতাপুত্র উভয়ের জন্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দ এবং গর্বের বিষয়। তবে ভূমিকা লেখার ব্যাপারে ইস্পাত কঠিন এবং অত্যন্ত কড়া নিয়ম কানুন ও রুচিবোধ সম্পন্ন এবং বিজ্ঞ পিতা এখানে বিন্দুমাত্রও আদিখ্যেতা বা বা বাহুল্য আবরণে বিচার বিশ্লেষণ করেন নি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ মানসিকতা দিয়েই বরাবরের মতোই তাঁর শাণিত এবং ক্ষুরধার কথামালা দিয়ে পুত্রের গ্রন্থটির মূল্যায়ন করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘হতাশা আর বঞ্চনায় জীবনের শেষ দেখেন না রুমি। শাটল ট্রেনের নিরানন্দ যাতায়াত, অবশেষে কদম , কৃষ্ণচূড়া, সোনালী চাঁপার সারি থেকে ভেসে আসা সুঘ্রাণের উজ্জীবন! এও তো জীবনের একটি সোনালী পর্ব। স্মৃতি সত্তায় নিবিড় আনন্দবেদনায় আপ্লুত জীবনের চালচিত্র। আশাই জেগে থাকে প্রাণের ক্রন্দনে। রুমি মেষবন্ধন ঘটিয়েছেন তাঁর অতীতের সাথে সমকালের। গোপন কান্নার শেষে আনন্দের অশ্রুর প্রত্যাশী কবি। নতুন পথের আলো ফোটে রুমির চোখে, রুমি লেখেন– সোনালী হৃদয়ে জাগে নতুন জোৎস্নার চর( বেঁচে থাকার অর্থ)। তিনি যথার্থই বলেছেন, যোগ্য শব্দের আবিষ্কারে , কবি ভাষার কুশলী রচনায়, রূপকল্প ও সংকেতের সফল প্রয়োগে কবিতা নির্মাণ ও শিল্পের সমন্বিত রূপ লাভ করেছে বলা যায়। আসলেই রুমি দূরগামী ট্রেনের হুইসেল, পাহাড়ে নাম না জানা পাখির কূজন, আর জেল নৌকার ইঞ্জিনের আওয়াজের শব্দচিত্রকে নিখুঁত বুননে তুলে এনছেনে কবিতার নকশিকাঁথায়। সুদূর প্রবাস থেকে মাটি ও মানুষের প্রতি প্রবল আকুতি তাঁর প্রতিটি কবিতার পরতে–পরতে। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে যে কেউই নিজের জীবনের সাথে যেন মিল খুঁজে পাবেন। ৬৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অনার্য পাবলিকেশন্স। চমৎকার প্রচ্ছদ করেন জাফর আকরাম। রুমি বইটি উৎসর্গ করেছে তাঁর মা আর বাবাকে। ঝকঝকে আর নির্ভুল ছাপা বইটিকে দান করেছে ভিন্ন নান্দনিকতা। এটির মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।