শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় আফ্রিকা–আরব রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজিত সংঘাত–সংঘর্ষ প্রশমনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন অভূতপূর্ব অবদান রেখে চলছে। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মতো বাস্তুচ্যূত শরণার্থীর ক্ষেত্রেও একই ধরনের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। আগামী ২৫ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের পিসকিপিং মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে সংস্থাটির পিচ অপারেশন বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স’র অংশগ্রহণ বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুমহান মর্যাদার নতুন অধ্যায় রচিত হতে যাচ্ছে। যে সময় কতিপয় কথিত উন্নত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নানা বৈরী পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে; একই সময়ে এ ধরনের সম্মেলন প্রকৃত অর্থেই আশাজাগানিয়া। শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের উচুমার্গের অর্জন ভূলুন্ঠিত করার হীন উদ্দেশ্যে অন্ধকারের শক্তির দেশবিরোধী নানামুখী প্রচার–অপপ্রচারে সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন। উল্লেখ্য বিশ্বজনীন বিশিষ্ট ব্যক্তির সফর এবং সম্মেলন অনুষ্ঠান দেশের জন্য অত্যন্ত সুখকর–ইতিবাচক বার্তাই বহন করে। তবে নষ্ট চরিত্রের দেশীয়–আন্তর্জাতিক রাজনীতিকদের কদর্য বোধদয়ে তা প্রোথিত হবে কিনা সে সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। অযাচিত–অনভিপ্রেত চাপ প্রয়োগের অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অনবদ্য অবস্থানকে নড়বড়ে করার ঘৃণ্য অপকৌশল অবলম্বন আশাকরি রুদ্ধ হবে।
দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষী সদস্যরা মিশন এলাকায় বিবদমান দলসমূহকে নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়তা প্রদান, সড়ক ও জনপথ এবং স্থাপনা তৈরিতে সক্রিয় কর্মযজ্ঞ পালনসহ কঙ্গো, মালি, সুদান, সাউথ সুদান, সাহারা, লেবানন, হাইতি, পূর্ব তিমুরে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। প্রায় তিন যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সকল প্রান্তের দুর্গত–নিপীড়িত–নিরীহ মানুষের সেবায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মানবিক হস্ত সর্বদা প্রসারিত। ১৯৮৮ সালে ইরাক–ইরান শান্তি মিশনে যোগদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন সদস্য জাতিসংঘের কর্মকান্ডে শামিল হন। ১৯৮৮ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ পেশাদারি মনোভাব, সততা, কর্মনিষ্ঠা, আনুগত্য ও সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশে তাদের অনন্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উঁচুমাত্রিকতায় সমাসীন এবং শান্তিরক্ষা মিশনে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিতে অত্যন্ত সফল–সার্থক হয়েছে।
১৯৯৩–৯৪ সালে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রুয়ান্ড, সোমালিয়া ও বসনিয়া– এ তিনটি শান্তি মিশনে নিজেদের সক্ষমতা–দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ঐ সময় জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্ট দেশসমুহের কর্মকর্তাদের হতবাক করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দক্ষতা ও সামরিক জ্ঞানে উক্ত দেশসমূহে মিশনে দায়িত্ব পালনরত বেলজিয়ান, আমেরিকান ও ফ্রান্স সেনাবাহিনীকে ছাপিয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা বিদেশের মাটিতে শত্রুদের সামনে মাথা নত না করে, কঠিন বিপদ–সংকটময় মুহূর্তে জীবনঝুঁকির মধ্যেও জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আইভরি কোস্টের গোলযোগপূর্ণ অবস্থাকালীন সময়ে লাইবেরিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টগুলো প্রত্যক্ষভাবে শরণার্থী পরিস্থিতি মোকাবিলাসহ লাইবেরিয়ার সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রকৌশল সহায়তায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক কর্মকান্ড স্থানীয় জনগণ ও সর্বমহলে উচ্চকিত।
১৯৯৩ সালে মোজাম্বিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সর্বপ্রথম ১৫ সদস্যের সামরিক পর্যবেক্ষক পেরণ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ইরাক–কুয়েতের জলসীমায় নিরাপত্তা বিধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্বতন্ত্র নৌ কন্টিনজেন্ট পাঠানো হয়। ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী শান্তিরক্ষা মিশন সুদানে মোতায়েনকৃত স্বতন্ত্র রিভারাইন ইউনিট ২০১২ সাল পর্যন্ত নিয়োজিত ছিল। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের চাহিদাক্রমে ২০১৫ সালের জুন মাসে দক্ষিণ সুদানে ২০০ জন মেরিন জনবল ও ১২টি লাইট পেট্রোল ক্রাফট সমন্বয়ে ফোর্স মেরিটাইম ইউনিট মোতায়েন করা হয়। এখানে জাতিসংঘের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নৌসদস্যরা নিত্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি, খাদ্য সামগ্রী, ওষুধপত্র ও মানবিক সাহায্য বহনকারী বার্জসমূহের নিরাপত্তা বিধান, নৌপথের জলদস্যুতা দমন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অগ্নিনির্বাপণে স্থানীয় জনগণকে সহায়তা, আহত সামরিক–বেসামরিক জনগণকে উদ্ধার এবং স্থানীয় জনগণকে চিকিৎসা সহায়তাসহ মিশনে নিয়োজিত সেনা–বেসামরিক জনগণের রসদ সামগ্রী দুর্গম স্থানে পৌঁছে দেন। উল্লেখ্য মেরিটাইম ইউনিট হোয়াইট নীল নদীর দীর্ঘ ৯৩৬ কি.মি. নৌপথে ৩৩টি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১০ সালে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরে জাতিসংঘ মিশন লেবাননে প্রথমবারের মতো দুটি যুদ্ধজাহাজ বিএনএস ওসমান ও বিএনএস মধুমতি মোতায়েন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সক্ষমতা এবং বিশ্বমানের দক্ষতারই প্রমাণ বহন করে।
১৯৯৩ সালে বসনিয়া–হার্জেগোভিনায় ইউএনপিআরওএফওআরে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে ইউনিকমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী হেলিকপ্টারসহ অংশ নেয় যা আট বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ২০০৩ সালে পূর্ব তিমুরে ইউএনএমআইএসইটিতে এবং ২০০৯–১০ সালে শাদে তিনটি বেল–২১২ হেলিকপ্টারসহ বিমানবাহিনীর একটি করে কন্টিনজেন্ট ও মুভমেন্ট কন্টোল প্লাটুন পাঠানো হয়। সর্বশেষ চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি ও ২ মার্চ মালিতে মোতায়েন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিয়েছেন বিমানবাহিনীর মোট ১১০ জন সদস্য। বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুসারে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ সালে নামিবিয়ার মিশনে যোগ দিয়ে এ পর্যন্ত ২১ হাজার ২৮৪ জন শান্তিরক্ষী ২১টি দেশের ২৩টি মিশনে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, সাইপ্রাস, সাউথ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, লিবিয়া ও সুদানে বাংলাদেশ পুলিশের ৫১২ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। ২০০০ সালে থেকে বাংলাদেশ পুলিশের নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ অনন্য মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সশস্ত্র বাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে ১২৫টি দেশের ৮৭ হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী ১২টি অপারেশনে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪০টি দেশে ৬৩টি মিশনে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছে। চলমান সময়ে বিশ্বের ১৪টি দেশে ৯টি মিশনে বাংলাদেশের ৭ হাজার ৪৩৬ জন সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত রয়েছে যা বিশ্বব্যাপী মোতায়েন শান্তিরক্ষীদের মোট সংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে ২ হাজার ৭২৮ জন নারী শান্তিরক্ষী সদস্য সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন এবং বর্তমানে ৫৭২ জন শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কর্মরত রয়েছেন। মিশন এলাকায় সংঘাতপূর্ণ–প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬৭ জন বাংলাদেশি বীর সন্তান নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ২৫৯ জন সদস্য আহত হয়েছেন। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালনে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সিয়েরালিওন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় তাদের দেশের প্রধান ভাষা বাংলা করতে না পারলেও দেশটির দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার প্রচলন বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা দিবস–২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ সবসময় শান্তিতে বিশ্বাস করে, সংঘাতে নয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করা দরকার সবই করবে। আমরা যে কোনো সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা চাই না। কারণ নারী, শিশু ও প্রতিটি পরিবার এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়ে। তাই তাদের এই দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করাই আমাদের লক্ষ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বে শান্তি নিশ্চিত করা অতীতের চেয়ে এখন বেশি কঠিন। কারণ, অশুভ শক্তি প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবনের শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। প্রযুক্তির সাম্প্রতিক বিকাশ ও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অশুভ শক্তির নতুন হুমকি বাড়ছে। প্রযুক্তি মানুষকে আর্থ–সামাজিক উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রে সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা এটাও দেখছি যে, অপশক্তিগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং মানুষের জীবনের শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। কাজেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শান্তিরক্ষীদের জটিল বহুমাত্রিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।’ প্রাসঙ্গিকতায় নির্দ্বিধায় দাবি করা যায়; প্রতিরক্ষাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সততা–নির্ভীকতা–একনিষ্ঠতা–আন্তরিকতার অসাধারণ সমীকরণে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ অগ্রগণ্য। স্বাভাবিকভাবে এটি প্রাত্যাশিত যে, অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলন দেশের ভাবমূর্তিকে অধিকতর উজ্জ্বল করবে। কোন কূটকৌশলে শান্তিরক্ষা থেকে বিরত নয়; সম্মেলনে সম্মানিত অতিথি মিশনের আন্ডার সেক্রেটারি আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর যোগদানের বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন– জনগণের পক্ষ থেকে এই আশাবাদটুকু নিবেদন করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়