শান্তিময় সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণে ধর্মচর্চার বিকল্প নেই

ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিম শাহ্‌ | শুক্রবার , ১ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ রাব্বুলআলামিন মানবকে নিজ গঠনে সৃষ্টি করে সমগ্র সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। মানবের মধ্যেই লুকায়িত সৃষ্টিরহস্য। হজরত জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) বলেছেন, ‘মানুষ অর্ধেক ফেরেশতাসম, অর্ধেক পশুসম’। অর্থাৎ মানবের মধ্যে ইতিবাচকতা ও নেতিবাচকতা দুটোই বিদ্যমান। ইতিবাচক কর্ম করলে সে আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। অপরদিকে কুকর্ম দ্বারা শয়তানের দিকে ধাবিত হয়। মানবকে সত্যমুখী করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিভিন্ন নবীরসূলের মাধ্যমে যুগেযুগে বিভিন্ন ধর্ম প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ রহমতুল্লিল আলামিন হজরত আহমদ মুজতবা মোহাম্মদ মুস্তফা (.)-এঁর মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ, সরল, যুগোপযোগী শান্তির ধর্ম ‘ইসলাম’ দিয়েছেন। ধর্ম আত্মিক প্রশান্তি দেয়। সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থার বন্ধনে আবদ্ধসহ সত্যের দিকে ধাবিত করে। এজন্য মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক।

ধর্ম মানুষকে মানবিক করে। প্রশ্ন হলো ধর্ম কী? মানব যা ধারণ করে সেটাই ধর্ম। আল্লাহ ‘ধর্মগ্রন্থে’ যা ধারণ ও পরিত্যাগ করতে বলেছেন সেভাবে জীবন অতিবাহিত করার নাম ধর্ম। সকল ধর্মেই নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে। আত্মাকে পরিচালনা করে মন। মনের অন্য রূপ হলো বিবেক, যা দ্বারা সত্যমিথ্যা পার্থক্য নিরূপিত হয়। বিবেকের অপর নাম চেতনা। চেতনা একটি শক্তি। এটি আধ্যাত্মিক শক্তি, এটি আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি, যা সুপ্তভাবে প্রতিটি মানবের মধ্যে বিদ্যমান। যিনি ধর্মচর্চার মাধ্যমে এশক্তি জাগ্রত করতে পারেন, তিনি আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। অন্তর্নিহিত এ শক্তিকে জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন ধর্ম। অর্থাৎ ধর্মচর্চা। ধর্মের দুটো দিক। একটি আনুষ্ঠানিকতা, অপরটি আধ্যাত্মিকতা। আনুষ্ঠানিকতা হলো ধর্মের বাতাবরণ। এটি বইয়ের মলাটের মতো। এর ভেতরেই রয়েছে ধর্মের প্রকৃত রূপ, যার নাম আধ্যাত্মিকতা। সবধর্মের মানুষ এটি গ্রহণ করেন। ধর্ম প্রাকৃতিকতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়, ধর্মে অপ্রাকৃতিক বলে কিছু নেই। ধর্ম সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড, নৈতিকতাকে সমর্থন এবং নেতিবাচক কর্মকে পরিত্যাগের পূর্ণ ব্যবস্থা। সহজ ভাষায়ধর্ম হল আত্মা, মহাত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও মিলিত হওয়ার উত্তম ব্যবস্থা। প্রাকৃতিকতা মানে আধ্যাত্মিকতা। আধ্যাত্মিক চর্চা ছাড়া সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। আধ্যাত্মিকতা বিবেককে জাগ্রত করে। সবধর্মেই নৈতিকতা (সত্যকে) ধারণ ও মিথ্যাকে বর্জনের শিক্ষা দিয়েছে। কোনো ধর্ম কখনো অনৈতিকতাকে সমর্থন করেনি। প্রকৃতির নিয়মে সৃষ্টির মধ্যে প্রত্যেকেই একেঅপরের সাথে আন্তঃসংযুক্ত, আন্তঃসম্পর্কিত। আত্মার সাথেও আন্তঃসংযুক্ত। এমনকী আল্লাহর সাথেও মানব আন্তঃসংযুক্ত ও আত্ম সম্পর্কিত। আর মানুষেমানুষে সম্পর্ক তো আছেই। সম্পর্ক আছে বলেই মানুষ অপরের ব্যথায় ব্যথিত, সুখে আনন্দিত হয়। একে অপরকে না চিনলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক, আন্তঃসংযোগ ও আত্মার বন্ধন রয়েছে। ধর্ম এই বন্ধনকে দৃঢ় রাখতে শিক্ষা দেয়। আধ্যাত্মিক শক্তি অহংকারকে ভেঙে চূর্ণ করে এবং মনুষ্যত্ব ধারণে সহায়তা করে। কতকব্যক্তি ধর্মকে বিশ্বাস করেন এবং ধর্মগ্রন্থকে সম্মান করেন। কিন্তু এটি যে একটি জ্ঞানগ্রন্থ তা বুঝে উঠতে পারে না। কারণ তথাকথিত ধর্মের লেবাসধারী কিছু ধর্মব্যবসায়ী সরলমনা মানুষকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখেছেন। তারা ধর্মকে আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। সামান্য রুজিরুটির জন্য ধর্মকে (পুঁজি করে) অনৈতিক কর্মে ব্যবহার করে। লেবাস পরিধান করে মানুষমানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। এরা ধার্মিক নামের কলঙ্ক। এরা সমাজ, রাষ্ট্রসহ সকলের জন্য ক্ষতিকর। অথচ ধর্মের শিক্ষা হচ্ছেবিচ্ছিন্নতা নয় বরং সহযোগিতা সহমর্মিতার মাধ্যমে পারস্পরিক সংযুক্তি, প্রভুত্ব নয়, বরং সেবার মানসিকতা নিয়ে (সমগ্র বিশ্বকে একটি পরিবার মনে করে) সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা। এজন্য যুগেযুগে ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে সুফিসাধকরা প্রেম, বিনয় ও উদারতার মাধ্যমে (ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে) বিচ্ছিন্ন সমাজকে একত্রিকরণে ভূমিকা রাখেন। ইসলাম ধর্ম সহ সকল ধর্মেই শান্তির কথা বলা হয়েছে। ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থই হলো শান্তি। ইসলাম পূর্ণ শান্তি ও যুগোপযোগী জীবনব্যবস্থার নাম। ইসলাম ধর্ম সর্বোচ্চ উদারতার ধর্ম। ইসলাম নিশ্চিত করেছেসবধর্মের অনুসারীদের নিরাপত্তার অধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, সম্পত্তিতে দিয়েছে নারীদের অধিকার, জ্ঞান অর্জন করার অধিকার। দিয়েছে (শালীনতার ভিত্তিতে) কর্ম করার অধিকার। সুফিরা বলেছেনপ্রয়োজনে নিজ স্বার্থের কিছু অংশ ত্যাগ করেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের মধ্যে কিছু লোক নিজ স্বার্থের জন্য সমাজে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতাসহ অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়। আর এই কুকর্মগুলো করা হয় ধর্মের দোহাই দিয়ে। এদের কারণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে ইসলাম মানে জঙ্গিবাদ, মারামারি, হিংসা, বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা। ইসলাম মানে ওজনে কম দেওয়া, অকারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। ধর্মকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, এর ভাব ও নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। যাঁরা নৈতিকতা হৃদয়ে ধারণ করে, তাঁদের দ্বারা কখনো সমাজে অকল্যাণ হতে পারে না। যে ন্যূনতমও ধর্ম ধারণ করে সে কখনো ওজনে কম দিতে পারে না, অকারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গুদামজাত করতে পারে না, খাদ্যে ভেজাল, রমজানে অতিরিক্ত মুনাফা, সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কখনো মূল্য বাড়াতে পারে না। বৃক্ষনিধন, পাহাড় কর্তন, পানি, আকাশ দূষণ সহ সার্বিকভাবে প্রকৃতির দূষণ করে না। যিনি ধার্মিক তিনি দেশের দুর্যোগ ও খাদ্য সংকটকালে গুদামজাত না করে বরং রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে একত্র হয়ে জনগণের কষ্ট লাঘবে ভূমিকা রাখেন। এরাই ধার্মিক। এদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহভীতি ও প্রেমানুভূতি জাগ্রত হয়। ফলে আল্লাহ ধর্মে যা করার নির্দেশনা দিয়েছেন তা পালন, যা করতে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকে। বিবেক তাঁকে অনৈতিক কর্মে বাঁধা দেয়। ধর্ম চর্চাকারীর মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। কারণ তিনি জানেনকৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে একদিন তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। তাই তাঁর মধ্যে একটি দায়িত্ববোধ জন্মে। দায়িত্ববোধের ফলে কোনো অনৈতিক কর্ম করার আগে একটিবার চিন্তা করে, বিবেক প্রতিনিয়ত তাঁকে দংশন করে। হৃদয়ের গভীর থেকে অদৃশ্য এক শক্তি বলে দেয়এটি মন্দকর্ম, এটি করিও না।

এক শ্রেণির লোক রয়েছে যারা ধর্ম চর্চা করে না। তাদের নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কতক লোক আছে যারা ধর্ম বিশ্বাস করে কিন্তু ধর্মচর্চা করে না। এদের মধ্যে কেউ ধর্মের আচারিকতাকে প্রাধান্য দেয়। কেউ কেউ ধর্মের নৈতিক চর্চা ব্যতিরেকে আনুষ্ঠানিকতাকে প্রাধান্য দেয়। তারা আনুষ্ঠানিকতাকে ধর্মে পরিণত করেছে। অনেকে ধর্মকে ঢাল হিসেবে নিয়ে ধর্মের অপব্যবহার করে। ধর্মের নামে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতাসহ ধর্মে ধর্মে বিবাদে লিপ্ত। ধর্মের দোহাই দিয়ে ভিন্নধর্মের অনুসারীদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়। ধর্মের নামে উগ্রবাদ, মারামারি বিভেদ বিচ্ছিন্নতায় লিপ্ত। যার ফলে ধর্মচর্চাকে অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। যেটি কোনোমতেই কাম্য নয়।

বর্তমান বিশ্বে অশান্তির একমাত্র কারণ; মানুষ ধর্মচর্চা থেকে বিচ্যুতি। শান্তিময় সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণে ধর্মচর্চার বিকল্প নেই। সমাজের মধ্যে যদি সঠিক ধর্মচর্চা হয় তাহলে এর সুপ্রভাব রাষ্ট্রের মধ্যে পড়বে। এভাবেই ধর্মের প্রভাবে বিশ্বে শান্তির সুবাতাস বইবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজম্মু-কাশ্মীরে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা