কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই চট্টগ্রাম–৮ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯০ কেন্দ্রের কোথাও কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির হার ছিল কম। বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা নগরীর চান্দগাঁও এবং বোয়ালখালী উপজেলার ১৯০ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ চলে। ভোট গ্রহণ শেষে বিকালের পর থেকে নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামস্থ জিমনেশিয়ামে স্থাপিত নির্বাচনী কন্ট্রোল রুম থেকে ফলাফল ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী স উ ম আবদুস সামাদ (মোমবাতি) এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী কামাল পাশা (আম) পুনঃভোটের দাবি করেছেন। এদিকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ার প্রতীকের প্রার্থী অধ্যক্ষ আল্লামা এস এম ফরিদ উদ্দিন এ নিয়ে গুরুতর কোনও অভিযোগ না করলেও তিনি এই উপ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয় এবং ইভিএমে মহিলা ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
তিন কারণে এবার ভোটার উপস্থিতি কম ছিল বলে মনে করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একদিকে তীব্র গরম, অন্যদিকে সাত মাস পরেই জাতীয় নির্বাচন। তাই এই নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ তুলনামূলক কম ছিল। এর পাশাপাশি নির্বাচনের দিন অফিস আদালত খোলা থাকায় অনেকে অফিসের কারণে নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এই ব্যাপারে জানতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে চট্টগ্রাম ৮ আসনের নির্বাচন শেষ হয়েছে। কোনও কেন্দ্রে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলার কোনও ঘটনা ঘটেনি, কোনও অভিযোগও ছিল না। নির্বাচনে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে।
নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল থেকে ভোটারদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। এই কেন্দ্রে সকাল ৮টায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, খুব সুন্দর পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিচ্ছেন। আশা করি জনগণ উন্নয়নের পক্ষের প্রার্থীকে রায় দিবেন। অপরদিকে সকাল ১০টায় এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে ইসলামি ফ্রন্টের প্রার্থী স উ ম আবদুস সামাদ কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং নৌকা প্রার্থীর অনুসারীরা জোরপূর্বক গোপন কক্ষে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ করেন। এছাড়া দুপুরে এখলাছুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি এ সময় বলেন, ইভিএমে একজনের ভোট আরেকজনে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আপনার ফিঙ্গারিং দিয়ে আপনি সত্যিকারের ভোটার কিনা তা যাচাই করা হবে। এরপর আপনার পছন্দের প্রতীকে সুন্দরভাবে ভোট দিতে পারবেন। এর থেকে সহজ সিস্টেম আর কি হতে পারে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সব সময় পেছনের কথা চিন্তা করি। এখানে ব্যালটের মতো কোনও সিল লাগে না, কিছু লাগে না। শুধু ফিঙ্গারিং করে ভোট দিলাম। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় লাগলো।
সকাল ১১টায় চান্দগাঁও ৪নং ওয়ার্ডের গোলাম নাজির বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় আবু সৈয়দ নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধকে কোলে করে ভোট দিতে কেন্দ্রে নিয়ে আসেন পাড়ার যুবকরা। এই কেন্দ্রের ভোটার লোকমান ইসলাম মুন্না আজাদীকে বলেন, ভোটার উপস্থিতি একটু কম হলেও যারা আসছেন তারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন। এসে কাউকে দাঁড়াতে হচ্ছে না। অফিস আদালত খোলা থাকার কারণেই ভোট তুলনামূলক কম কাস্ট হয়েছে। আমার নিজেরও অফিস ছিল, কিন্তু আমি ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। আমাদের এলাকার সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়ে ভোট দিয়েছে। ভোট দিতে গিয়ে কাউকে কোনও ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি।
এদিকে সকাল পৌনে এগারটার দিকে আল আমিন বারিয়া কামিল মডেল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে ৮০ বছর বয়সী জুনি বড়ুয়া নামে এক বৃদ্ধাকে ভোট দিয়ে বের হতে দেখা যায়। তিনি ভোট দিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ১০টা ৫৫ মিনিটের দিকে এই কেন্দ্রের তৃতীয় তলায় উঠে দেখা যায়, কেন্দ্রের ৫নং বুথে এক নারী ভোটার ভোট দিতে না পেরে বেরিয়ে আসছেন। পরক্ষণে সেই বুথে প্রিসাইডিং অফিসার মোরশেদ আলম আসেন। তিনি এসে দেখতে পান হঠাৎ ইভিএম মেশিন কাজ করছে না। তখন তিনি মুঠোফোনে বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কন্ট্রোল রুমে জানান। এসময় ২ হাজার ৫১৬ ভোটের মধ্যে ৮৮ ভোট কাস্ট হওয়ার কথা জানান প্রিসাইডিং অফিসার।
মোহরা এলাকার আল হিকমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. আশরাফুল হক বলেন, এই কেন্দ্রে ৪ হাজার একজন মহিলা ভোটার আছেন। এর মধ্যে ২৬৪জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। যা মোট ভোটারের মাত্র ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ।
এদিকে নগরীর নজিরিয়া নঈমিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে দিয়ে দেখা যায় ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। এই কেন্দ্র পরিদর্শনে আসনে এই মোহরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী নুরুল আমিন মামুন। তিনি বলেন, অন্যান্য জাতীয় নির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে ভোটের উপস্থিতি একটু কম হলেও ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এসে ভোট দিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে নজিরিয়া নঈমিয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় ভোটারদের সরব উপস্থিতি থাকলেও উল্টো চিত্র দেখা গেছে পাঁচলাইশ মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চান্দগাঁও শমসের পাড়া হাজী চান মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চান্দগাঁও সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে। বেলা সাড়ে ১১টায় মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা গেছে, কেন্দ্রের বাইরে উঠতি বয়সী ছেলেদের জটলা। তবে তারা কেউ ভোটার নন। এছাড়া ভোটারদের কোনও লাইন ছিল না। মাঝে মাঝে কয়েকজন ভোটারকে গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোট দিতে দেখা গেছে। কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং অফিসার আতিকুর রহমান সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ চলছে বলে দাবি করেন। প্রার্থীদের এজেন্টরাও রয়েছেন। সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত শতাধিক ভোটার ভোট দিয়েছেন বলে তিনি জানান। অন্যদিকে দুপুর ১টায় চান্দগাঁও শমসের পাড়া হাজী চান মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ভোটারদের উপস্থিতি একদমই কম। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তেমন ব্যস্ততা নেই। অনেকক্ষণ পর পর একেকজন ভোটার এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং অফিসার নাজিম উদ্দিন বলেন, ভোটগ্রহণে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। ভোটার এসে ঝামেলামুক্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন বলে তিনি জানান। অপরদিকে দুপুর ২টায় চান্দগাঁও সিডিএ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে দেখা গেছে, ভোটারের উপস্থিতি একেবারে নগন্য।
কয়েকটি কেন্দ্র ছাড়া কোনও ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়নি। অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রে সকাল ১০টা পর্যন্ত মাত্র দুই থেকে তিন শতাংশ ভোট কাস্ট হয়। এরপর বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোট কেন্দ্রে ভোটার কিছুটা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত খুব বেশি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। বেশিরভাগ কেন্দ্রে ১০ থেকে ১২ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। আবার অনেক কেন্দ্রে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশও ভোট কাস্ট হয়েছে বলে প্রিসাইডিং অফিসারদের কাছ থেকে কথা বলে জানা গেছে। তবে নগরীর কেন্দ্রগুলো থেকে বোয়ালখালী উপজেলার কেন্দ্রগুলোতে ভোট বেশি কাস্ট হয়েছে। বোয়ালখালীর বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মটর রিকশা করে ভোটারদেরকে এনে স্বেচ্ছাসেবকরা ভোট দিয়ে আবার নিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোট গ্রহণ শুরুর পর আইনশৃক্সখলা বাহিনী ও ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অলস সময় পার করছেন। ভোটার উপস্থিতি কম থাকায় এসময় তাদেরকে খোশ গল্পে সময় কাটাতে দেখা যায়।
এদিকে বোয়ালখালী উপজেলা সদরস্থ গোমদন্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বাইরে পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এসময় ৯৫ বছরের নুরুল আলম সিকদার ছেলের কাঁধে ভর করে ভোট দিতে এসেছেন। তিনি তেমন কথা বলতে না পারলেও ক্ষীণ কণ্ঠে বলেন, আমি সারা জীবন নৌকায় ভোট দিয়েছি। জীবনের শেষ ভোটটিও নৌকায় দিতে পেরে ভালো লাগছে।
এই কেন্দ্রে আরো দেখা যায়–মোটর রিকশায় করে নারী ও বয়ষ্ক ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। এসময় বেশ কয়েকজন নারী ও বৃদ্ধাকে ভোট দিয়ে বের হতে দেখা গেছে। কোহিনুর আক্তার ও মমতাজ বেগম নামে দুই ভোটার ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে জানান, ইভিএমে ভোট দিয়েছি। কোনও সমস্যা হয়নি। কেন্দ্রে কোনও ভীড় নেই। একই ভোট কেন্দ্রের দ্বিতীয় তলায় উঠে দেখা যায়, নৌকার এজেন্ট ছাড়া এই কেন্দ্রে অন্য কোনও প্রার্থীর এজেন্ট নেই।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আতিক উল্লাহ আজাদীকে বলেন, এই কেন্দ্রে ৩৩ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। ২ হাজার ৮৫৬ ভোটের মধ্যে ৯৫২ জন ভোট দিয়েছেন।
পশ্চিম গোমদন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় গিয়ে দেখা যায় শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. সোহেলকে তার প্রতিবেশি ভোট দিতে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। এসময় সোহেল আজাদীকে বলেন, জীবনের প্রথম ভোট দিয়েছি। ইভিএমে ভোট দিয়ে ভালো লাগছে।
এদিকে বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম গোমদন্ডী চাঁন্দারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২২নং কেন্দ্রে মোট ১ হাজার ৮৬৬ ভোটের মধ্যে ২৬৮ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার সুব্রত চৌধুরী। তিনি বলেন, এই কেন্দ্রে বিকেল চারটা পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। একই সেন্টারের ২৩ নং পুরুষ কেন্দ্রে ২ হাজার ৪৫ ভোটের মধ্যে ৩৪৮ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার সূর্য কান্তি শীল। তিনি বলেন, দুপুর একটা পর্যন্ত ১৭ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে।
এদিকে মোমবাতির প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট এম সোলায়মান ফরিদ রিটানিং কর্মকর্তা বরাবরে তার লিখিত অভিযোগে জানান, পোপাদিয়ার ৫২ ও ৫৫নং কেন্দ্রে যথাক্রমে রফিক স্মৃতি ও খাজা গরীবে নেওয়াজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে, ৬৫নং চরণদ্বীপের ঘাটিয়াল পাড়া, ১৭৫নং মোহাম্মদীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১২১নং আল হুমাইরা মহিলা মাদ্রাসা, ১২২নং রাবেয়া বশরী ইনস্টিটিউট, ১৫৫নং পূর্ব ষোলশহর কেন্দ্রসহ ১৫টি কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে।