পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে আবৃত, প্রকৃতির হাতে গড়া অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। কর্ণফুলী নদীর কোল ঘেঁষে উত্তরে প্রবাহমান ইছামতী নদী বেষ্টিত এই উপজেলার শান্ত সুনিবিড় এক গ্রাম শান্তিনিকেতন। যার নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান শান্তিনিকেতন পরিভ্রমণকারী সিদ্ধপুরুষ মহাত্মা সুবল সাধু। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকের বসতি এই গ্রামে বহুকাল আগে থেকে সংস্কৃতি চর্চার সাথে প্রতি বছর মঞ্চায়ন হতো নাটক, যাত্রাপালা প্রভৃতি। বাংলা নববর্ষ, নবান্ন উৎসব, পৌষ সংক্রান্তি, পিঠা উৎসব সহ বিবিধ বাঙালি কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদিতে মেলার আসর বসত নিয়মিত যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল নানান পদের মিষ্টি। মিষ্টি একদিকে যেমন উপহার, তেমনই নানা উছিলায় সঙ্গীও বটে। এমন বাঙালি বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মিষ্টি নেই। আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে আকার, রং, স্বাদের তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন রকম মিষ্টি উৎপাদন হয়। শান্তিনিকেতনের রসগোল্লা সেইরকমই এক পদ যা শুরুর পর থেকে গুণ ও মান অক্ষুণ্ন রেখে প্রায় তিন দশকের বেশি সময় গ্রাহকের চাহিদা মিটিয়ে চলছে। শান্তিনিকেতনের এই রসগোল্লা স্বাদ এবং গুণে-মানে সকল খাদ্যরসিকের নিকট জনপ্রিয়।
এই রসগোল্লা তৈরির মূল উপাদান গরুর দুধকে ছানায় রূপান্তরিত করে রসনাবিলাসীদের অন্যতম পছন্দের এই খাবার প্রস্তুত করা হয় । ছানা, দুধ, চিনির সংমিশ্রণে তৈরি হয় সকল শুভ অনুষ্ঠানের অন্যতম খাদ্য এই রসগোল্লা। বর্তমানে সাদা মিষ্টি, কালো জাম, চমচম রসমালাই, মিষ্টি দধি, নিমকি, জিলাপি, খাজা, আমৃত্তি, স্পেশাল মালাইকারি প্রভৃতি বাহারি নামের ও বিচিত্র মোহনীয় স্বাদের মিষ্টান্ন তৈরি করা হয় এই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। তবে এর মধ্যে রসগোল্লা বা সাদা মিষ্টির চাহিদা সবচেয়ে বেশি যা দৈনিক গড়ে ৫০ কেজির মত তৈরি ও বিক্রি হয়। নির্ভেজাল উপাদান ও গরুর খাঁটি দুধে তৈরি হওয়া স্বাদে অতুলনীয়, দেখতে লোভনীয় ও জিবে জল আনা সাদা মিষ্টি, রস মালাই, ক্ষীর মোহন, স্পেশাল মালাইকারী প্রভৃতি এক একটি আইটেম মুখে দিতে যেন নিমিষেই মিলিয়ে যায়। যা রসনাবিলাসী খাদ্যরসিকদের লোভ সংবরণকে যেন হার মানায়! প্রকারভেদে সাদা মিষ্টি ২০০ টাকা, কালো জাম ২০০ টাকা, চমচম ২৬০ টাকা, ক্ষীর মোহন ৩৫০ টাকা, রস মালাই ৩৫০ টাকা, মিষ্টি দই ২২০ টাকা, নিমকি ১৮০ টাকা ও জিলাপি ১৫০ টাকা কেজিপ্রতি বিক্রি হয়।
বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী সকল রকমের মিষ্টির চাহিদা অত্র এলাকায় শীর্ষে থাকে। এলাকার খাদ্যরসিকদের তৃপ্তি মিটিয়ে শান্তিনিকেতনের রসগোল্লা এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। সুনাম কুড়িয়েছে দেশের বাহিরে প্রবাসেও।
শান্তিনিকেতনের এই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারটির গড়ে উঠার পিছনে রয়েছে সংগ্রামী এক ইতিহাস। এই জনপদের মানুষ মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল এবং তম্মধ্যে পান চাষ অন্যতম। ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সবকিছু এলোমেলো করে দেয়ায় এলাকার মানুষ তখন পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবতে থাকে। গ্রামের যশস্বী পান ব্যবসায়ী গুণলাল দে’র পানের বরজ ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ছোট্ট পরিসরে চায়ের দোকান চালু করেন। পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের পরামর্শ ও সহযোগিতায় সেখানে গড়ে তুলেন রসগোল্লা তৈরির কারখানা। গুণলালের সেই ছোট্ট চায়ের দোকানটি আজ আর ছোট নেই। অবকাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে এর পরিধিও হয়েছে বিস্তৃত। শান্তিনিকেতনের রসগোল্লা মানেই এখন গুণলালের তৈরি রসগোল্লা। বর্তমানে দৈনিক কয়েক মণ মিষ্টি তৈরি ও বিক্রয় হয় শান্তি মিষ্টি ভাণ্ডার থেকে। তবে মিষ্টির গুণ ও মান ধরে রাখতে অন্য কোথাও সরবরাহ বা অন্য কোনো শাখা নেই তাদের। তাই সপ্তাহের অন্যান্য দিন ছাড়াও ছুটির দিনে লম্বা লাইন দিয়ে কিনতে হয় রসনাবিলাসীদের মুখরোচক এই পদটি।
বাংলা সাহিত্যে রসগোল্লাকে নিয়ে রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচনা করেছেন সরস সাহিত্য কর্ম। তার রচিত বিখ্যাত রম্যগল্প ‘রসগোল্লা’ যা ইউরোপের বহুদেশে সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া মিষ্টি নিয়ে একটি খনার বচন রয়েছে।
‘যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট/তত জ্বালে ভাত নষ্ট’ অর্থাৎ মিষ্টি যত জ্বালানো যাবে তত ভালো, আর ভাত যত জ্বাল দেয়া হবে তত নষ্ট হবে।
রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বরিশাল অঞ্চলে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় যেখানে পর্তুগীজদের সময় সেখানকার ময়রাগণ ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার একধরনের মিষ্টান্ন তৈরি করতেন যা ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এর বিস্তার ঘটে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেন শান্তিনিকেতনের মতিলাল দে। যা পরবর্তীতে মতি’র মিষ্টি নামে পরিচিতি পায়। এলাকার হাট বাজারে নিয়মিত বিক্রি করতেন তিনি। স্বাদে গন্ধে অপূর্ব মোহময়তা সৃষ্টিকারী এই রসগোল্লার আস্বাদনে দূর এলাকার লোক ছুটে আসত। একানব্বই’র ঘূর্ণিঝড়ের পর শান্তিনিকেতনে গুণলাল দে এই রসগোল্লা তৈরিতে মনোযোগী হোন।
এই রসগোল্লা তৈরি এবং জনপ্রিয় করে তুলতে গুণলালের শ্রম, নিষ্ঠা ও মেধা ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে এই রসগোল্লার ব্যাপক চাহিদায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে অনেকের। বিভিন্ন জন এলাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে আনেন মিষ্টান্ন তৈরির প্রধান কাঁচামাল গরুর দুধ। এতে নিয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের লোকেরা আজ সচ্ছল। যেখানে ব্যবসায়িকগণ অতি মুনাফা লাভের প্রত্যাশায় খাদ্যে ভেজালের আশ্রয় নিয়েছেন সেই জায়গায় এখনো গুণলাল রসগোল্লা সহ তৈরিকৃত অন্যান্য মিষ্টির গুণগত মান বজায় রাখতে সক্ষম রয়েছেন। অসাধু ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ও লোলুপতা পরিহার করে গ্রাহকের নিকট খাঁটি রসগোল্লা ও মিষ্টি পরিবেশনে তিনি সদা তৎপর। মিষ্টি ভাণ্ডারটির স্বত্বাধিকারী জানান, শুরু থেকে তৈরিকৃত মিষ্টির গুণ ও মান ধরে রেখে স্বল্প লাভে আমরা গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিচ্ছি। গ্রাহক সন্তুষ্টিই আমাদের মূল লক্ষ্য।
ঐতিহাসিকভাবে এই রসগোল্লা তৈরির মূলে ছিল অবিভক্ত ভারতের এক কিশোরীর এক ময়রাকে লক্ষ্য করে নিবেদিত এই ধাঁধাঃ
চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা,
দেখতে হবে ধবধবে চাঁদপানা।
এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই,
নবীন ময়রা এমন মিষ্টি চাই।
নবীন ময়রা এই ধাঁধার আলোকে তৈরি করেন এই রসেভরা সুস্বাদু রসগোল্লা। বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য এই রসগোল্লা। মিষ্টিমুখ করা মানে মুখে রসগোল্লা পুরে দেওয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়