গত ২৬ জুলাই ২০২৫ ইমতিয়াজ হোসেন শাকিলের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। অন্ধের যষ্টি ছেলেকে হারিয়ে অদ্যাবধি বৃদ্ধ বাবা–মা জগদ্দল পাথরের মত শোকের বোঝা বয়ে চলেছেন। তাদের সুন্দর সাজানো সংসারে এখন অমাবস্যার কালো ছায়া জমাট বেঁধেছে। হাসপাতালে ক্যান্সারাক্রান্ত প্রাণপ্রিয় সন্তানকে সঙ্গ দিতে গিয়ে সত্তরোর্ধ্ব বাবা সাবেক প্রধান শিক্ষক জনাব শওকত হোসেন ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এক বছরের অধিককাল ধরে রোগশয্যায় শায়িত। যতই দিন যাচ্ছে ততই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার শিকার হচ্ছেন। ওদিকে শাকিলের ক্যান্সারাক্রান্ত হওয়ার শুরু থেকে প্রায় তিন বছর গর্ভধারিনী মা মুক্তারা বেগমের অবিরাম অশ্রুসিক্ত নয়ন এখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম। জামালখান কুসুম কুমারী সিটি কর্পোরেশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষিকা মা কর্মজীবনে একজন সফলকাম মানুষ গড়ার কারিগর। বর্তমানে প্রাণপ্রিয় ছেলে হারানোর মর্মদাহী ব্যথা আর মুমূর্ষু স্বামীর সেবাশ্মশ্রুষায় একজন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হিসেবে দিনাতিপাত করছেন।
একদিকে বয়সের ভারে আক্রান্ত, অন্যদিকে রোগশোকে কাহিল মা–বাবার এহেন নারকীয় যন্ত্রণায় আমেরিকা প্রবাসী বড় মেয়ে শারমিন আর একমাত্র ছেলে শামীম জীবনের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়েছে। দুনিয়ার পীরখ্যাত মা–বাবা দুজনের রোগমুক্তির জন্য শত চেষ্টাতদবির সত্ত্বেও অপারগতায় তাদের শান্তি নির্বাসনে গিয়েছে। শাকিলের ক্যান্সারের শুরু থেকে রক্তের বাঁধন শামীম ভারতের চেন্নাইতে মাসের পর মাস কাটিয়েছে। বাংলাদেশের ঢাকা–চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে যেখানেই ক্যান্সার চিকিৎসার নূন্যতম আভাস পেয়েছে সেখানেই ছুটে গেছে। তথাপি ঘাতক ক্যান্সারের মরণথাবা থেকে ভাইকে রক্ষা করতে পারেনি। শাকিলের বিধবা সহধর্মিনী রুমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আরো মর্মান্তিক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মাত্র ১৬ বছরের দাম্পত্য জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে সৃষ্টিকর্তা শাকিলকে ছিনিয়ে নেবেন – এটা ছিল কল্পনাতীত। শাকিলের ক্যান্সারের শুরুতে রুমা নিজেই ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এখন কেবল দুটো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে আর শ্বশুর–শাশুড়ির মুখপানে তাকিয়ে শোককে চাপা দিয়ে বেঁচে আছে।
১৫ বছরের রাইসা আর ১৩ বছরের রিয়াসাত এখন শাকিলের ভাঙ্গা সংসারের খুঁটি। ক্ষণিকের তরেও দাদা–দাদুর চোখের আড়ালে গেলে মুমূর্ষু দাদা খাট থেকে পড়ে যেতে পারে অথবা স্নেহময়ী দাদুর শোকানল আবার জেগে উঠতে পারে – এই ভয়ে এই কচিবয়সেও তারা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এমনকি খেলাধুলা ঘোরাঘুরি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছে। পরম করুণাময়ের কাছে অনন্ত শুকরিয়া, এত ঝড়ঝাপ্টা সত্ত্বেও রাইসা সদ্যপ্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে আশাতীত ফলাফল করেছে। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত মা ও দাদা, ক্যান্সারাক্রান্ত বাবা, বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভোগা দাদুর সেবা করতে গিয়ে দুই ভাইবোনকে সকাল–সন্ধ্যা ব্যস্ত থাকতে হয়। বলতে গেলে শাকিলের পরিবারে এখন সর্বাঙ্গে ব্যথা।
শাকিলের মৃত্যু তার বন্ধুমহলে চরমভাবে নাড়া দেয়। শাকিলের রোগাক্রান্তের দিনগুলোতে বন্ধুরা যেভাবে অকাতরে এগিয়ে এসেছিল তার তুলনা বিরল। জীবদ্দশায় সমাজের সর্বস্তরে শাকিলের বিচরণ ছিল বটে। বন্ধুমহলে তাদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ। সুশিক্ষিত, আত্মত্যাগী, নিরহংকার, প্রচারবিমুখ, অসামপ্রদায়িকতায় পরিচ্ছন্ন যুবকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তাদের বন্ধুবলয়। প্রথিতযশা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বুদ্ধিজীবী, সমাজহিতৈষীরা ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্বনামধন্য চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টায় শাকিলের চিকিৎসায় ত্রুটি হয়নি। মানুষ মানুষের জন্য – এই সত্য তত্ত্ববাণী তাদের টিমে শতভাগ দৃশ্যমান। এরমধ্যে রুমেলের মা নামীয় জনৈকা সত্তরোর্ধ্ব মহিলার সেবাশ্মশ্রূষা অতুলনীয়। অদ্যাবধি শাকিলের বিধবা স্ত্রী ও ছেলেমেয়েসহ পরিবারের সবার নিয়মিত খোঁজখবর নিতে বেচারির চেষ্টার কমতি নেই। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী রুমেল বাংলাদেশে এলে শত ব্যস্ততার মাঝেও শাকিলের পরিবারের খোঁজখবর নিতে ভুল করে না। শাকিলের বউ–বাচ্চার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না – রুমেলের মায়ের মুখের এই বাক্য বলতে গেলে শাকিলের বিপদগ্রস্ত পরিবারের জন্য এক অপরিমেয় সাহস। গতবছরের এইদিনে বেলা বারোটার দিকে শাকিল ইহজগত ছেড়ে চলে গেলেও হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠার আশঙ্কায় ডাক্তাররা তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করেন আরো অনেক দেরিতে। শাকিলের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে মহান আল্লাহতাআ‘লার দরবারে সবার সুস্থতা কামনা আর পরকালের অনন্তজীবনে শাকিল জান্নাতবাসি হোক – এটাই একমাত্র প্রার্থনা।