শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বীর সন্তান গেরিলা যোদ্ধা শহিদ রুমীকে নিয়ে বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক সুজন বড়ুয়া আবেগময় উপন্যাস ‘ভোরের সূর্যমুখী’ এক অনন্য সাধারণ ঐতিহাসিক উপন্যাস–যার পাতায় পাতায় আছে চমক–অসাধারণ দৃশ্যের বর্ণনা এবং কাহিনী। বলা যায় একটানে পড়ে ফেলার মতো একটি উপন্যাস। ত্রিশ পর্বের আকর্ষণীয় ছোট ছোট শিরোনামে ১৬০ পৃষ্ঠার পুরো উপন্যাসের বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সেক্টর ২ এর ক্র্যাব প্ল্যাটুনের বীরত্বগাথা এবং শহিদ রুমি যেখানে এক অন্যতম নায়ক। তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে পুরো উপন্যাসের কাহিনী ঘটনা চিত্রকল্প এবং পরিণতি।
আমরা জানি–ক্র্যাব প্ল্যাটুনের প্রায় সব ধরনের সদস্য ছিল আরবান গেরিলা যাদের অন্যতম কৌশল ছিল ‘হিট এন্ড রান’ মেলাঘরের দু’তিনমাস প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকার বুকে একের পর এক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্যালিঙ্গ পেট্রোল পাম্প থেকে উলন পাওয়ার স্টেশন, যাত্রাবাড়ি পাওয়ার স্টেশন, সিদ্ধরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ইউএস ইনফরমেশন স্টেশন এমন কি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দু’দফা হামলা, যে কারণে আতঙ্ক, ভয় আর হতাশায় ছিল হানাদারেরা।
দুর্ভাগ্য এই বীর গেরিলাদের ২৫ আগস্টের রাতে ‘ডেসটিনেশন আননোন–এই অভিযানের পরে নেমে আসে ঘনঘোর অন্ধকার। প্রথমে অভিযান শহীদ আজাদের মায়ের বাসভবনে–যেটি ছিল গেরিলা যোদ্ধাদের ‘নিরাপদ আশ্রয়’। ওখানে ধরা পড়েন অনেকে এবং একমাত্র কাজী ছাড়া যিনি অদম্য সাহসে পাখিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একজন সৈন্যকে গুলিবিদ্ধ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু অন্যরা সবাই ধরা পড়ার পরে একে একে অনেক বীর সন্তানদের আস্তানায়। দুর্ভাগ্য বা বোকামিও ২৫ আগস্টের এতো বড়ো সফল অভিযানের পরেও তাদের প্রায় সবাই ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন এবং গ্রেফতার হলেন।
শহীদ রুমীও ধরা পড়েন নিজের বাসভবনে। ‘ভোরের সূর্যমুখী’ উপন্যাসটি রুমীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তাঁর পারিবারিক জীবন শৈশব–তারুণ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে তাঁর প্রত্যাঘাত প্রেমের গল্পও।
শৈশব কৈশোর থেকেই রুমী গড়ে উঠেছে একজন মেধাবী জ্ঞানী ও অসাধারণ দেশপ্রেম নিয়ে। যার নায়ক ছিল চেগুয়েভারা। তবে তাঁর গড়ে ওঠার পেছনে ছিলেন এক মহীয়সী নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, পর্ব এক মা ছেলের আদিন যায় রুমীর বেড়ে ওঠার বিস্তারিত বর্ণনা, “ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় দেখা গেল Reader’s Digest কিনে পড়ছে।” রুমীকে বই রাখার আলাদা শেলফ বানিয়ে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে বানিয়ে দেওয়া হলো একটি রাবার সিল। তাতে লেখা “Rumi’s own Library” পৃ: (১৪)
“নূপূরের বিয়ে হয়ে গেছে’ এই খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেন এই ভালো না লাগা বোধ ঝড়ের মতো ধেয়ে আসছে?” (পৃ ২৯)
“হঠাৎ দরজা খুলল রুমী শুকনো মুখ, উজেকোখুজকে চুল, এলোমেলো বেশ ভূষা, যেন প্রবল ঝড়ে ভেঙে পড়া কোন তরুণ বৃক্ষ। মানে দেখেও ভাবান্তর তার কোন ভাবান্তর নেই।” (পৃ: ৩১)
তবে এই পর্বের পর থেকে অন্য আরেক রুমী। মার্চের অগ্নিঝরা সময়ের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয় ধীরে ধীরে গেরিলাযোদ্ধা।
“মা এগিয়ে গিয়ে আলনায় ঝোলানো কাপড় সরিয়ে দেখেন, সুতলি দিয়ে মুখ বাঁধা কয়েকটা মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। মা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না আর। কাঁপতে কাঁপতে মনে ভেতরে ভিড় করে এলো নানা প্রশ্ন এ টালমাটাল সময়ে এমন দুটি তরুণ তাজা ছেলেকে আমি কীভাবে আগলে রাখব? পৃ ৪৭
অতঃপর বিভিন্ন পর্বে আকর্ষণীয় শিরোনামে রুমীর মেলাঘরে যাওয়া প্রদক্ষিণের নেতৃত্বে অতঃপর দেশে ফিরে নামা অভিযানে অংশগ্রহণে এবং ভয়াল ২৯ আগস্টের রাত গ্রেফতার ও এমপি হোস্টেলে নারকীয় যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত শহীদ হওয়া। শেষ পর্বে লেখক মায়ের সঙ্গে রুমীর দেখা শিরোনামে মা ও সন্তানের অদৃশ্য কথোপকথন–আম্মা যাওয়ার বেলায় তোমার জন্য একটি কবিতা আবার শুনিয়ে যেতে চাই। বইটা তুমিই আমাকে পড়তে দিয়েছিলে–খলিল জিবরানে প্রফেট বইয়ের লেখা-‘তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়–তারা জীবনের সন্তানসন্ততি জীবনের জন্যই তাদের আকুতি’ যদিও রুমীর আকুতি ছিল দেশের স্বাধীনতা।
সুজন বড়ুয়ার এই উপন্যাসে চিত্রময়তা কম বেশি বিরাজিত, যা নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রের অপার সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয় বারবার। এটিকে তার এ উপন্যাসের মৌলিক শৈলী মনে হয়েছে। প্রতিবেশ বর্ণনায়, চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, বিষয় বস্তুর প্রেক্ষাপট ও সাবলীল সংলাপ ঘটনা বর্ণনার দ্রুতিময়তা। সার্থক চলচ্চিত্রিক বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের কাহিনী প্রবাহ সহজসরল বাক্যে, শব্দের বিভিন্ন রঙে, ফ্ল্যাশ ব্যাকের সড়ক ধরে এগিয়ে গেছে সাবলীলভাবে। পাঠক এতে সহজেই আবিষ্কার করবেন এর শাল প্রাংশু সূর্য উপাসককে যে বয়সে একেবারে তরুণ কিন্তু মেধা ও মননে এক অসাধারণ বীর গেরিলা যোদ্ধা যে কিনা টর্চার সেলেও ছিল নির্ভীক শেষ মুহূর্তে বাবাও ছোটভাইকে বলছে ‘তোমরা কিছু জানো না সেই কথাটাই সব সময় বলবে। আমি কি ফার বেড়াই, তোমরা কোনদিন টের পাওনি। এর যেন কোন হেরফের না হয় (পৃ. ১৪৬)
নামকরণও সার্থক কারণ যুদ্ধের বাস্তবতায় তরুণরা এবং রুমী জীবন দিলেও ‘পাখি ডাকছে পূর্ব আকাশ লাল, সূর্য আসছে রাতের অন্ধকার ঢেকে দিতে’। সুজন বড়ুয়ার এ উপন্যাসে তিনি এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় চলে গেছেন– অন্তর্নিহিত স্রোতকে ঠিক রেখে–বর্ণনায় রূপ ও রঙ এসেছে চিত্র শিল্পের মতো বাক্যগুলো দীর্ঘময় কিন্তু সাবলীল প্রাণময়।
আবারও বলি– এ উপন্যাস একটানে শেষ করার মতো একটি গ্রন্থ বিশেষত নতুন প্রজন্মের জন্য দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উপন্যাসের বহুল প্রচার ও পাঠক প্রিয়তা নিয়ে আমি আশাবাদী।
এ উপন্যাসের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী হাশেম খান। চমৎকার প্রকাশনায় আদিগন্ত প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী মোশতাক রায়হান, উৎসর্গ করেছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে। দাম রাখা হয়েছে তিনশত পঞ্চাশ টাকা।
লেখক : সাহিত্যিক, সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ