মুসলিম হল চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের নাম। এ হলের সঙ্গে চট্টগ্রামের সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক। একই সঙ্গে রাজনীতিরও। শতাব্দী কাল ধরে হলটির নাম মানুষের মুখে মুখে ফিরে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে যুগের পর যুগ আধুনিক স্থাপনার হল ঘরটি দাঁড়িয়ে ছিল। নাটক থিয়েটার থেকে শুরু করে শিল্প সাহিত্যের অনুষ্ঠানে হলটি মুখরিত থাকতো প্রায় সময়। বিভিন্ন ধরনের সভা সমাবেশ এ হলে অনুষ্ঠিত হতো। হলটিতে কোন না কোন অনুষ্ঠান লেগে থাকতো, প্রচুর লোক সমাগম হতো। জায়গাটির নামও হলের নামে সবাই জানতো। রিক্সা বা টেক্সিকে বলার সঙ্গে সঙ্গে চিনে যেতো। হলের আশেপাশে অনেক খালি জায়গা থাকায় লোক সমাগমে কোন অসুবিধা হতো না। পরে পূর্ব পাশে পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে উঠে। লাইব্রেরী নিরিবিলি থাকলেও পাঠকের আনাগোনা লেগে থাকতো।
বায়ান্নের মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে পূর্ব বাংলায় শহীদ মিনার গড়ে উঠে। চট্টগ্রামে মুসলিম হলের সামনে রাস্তার দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের পাদদেশে শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়। ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাঙালি স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার হতে থাকে। শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে শপথ নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার দৃঢ় শপথ। ধীরে ধীরে শহীদ মিনার হয়ে উঠে প্রতিবাদের স্থান। অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে মানুষ জমায়েত হতে থাকে শহীদ মিনারের পাদদেশে।
একুশে ফেব্রুয়ারি এলে জায়গাটা অন্যরকম হয়ে যায়। রাতভর জেগে থাকে অনেকে, প্রহর গুণতে থাকে। কখন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে শহীদদের প্রতি। প্রথম প্রথম বাধা আসতো। শাসকদের পক্ষ থেকে বাধা, ধর্মান্ধুদের কাছ থেকে বাধা। ছাত্ররা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্র শিক্ষক আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার আগে এগিয়ে আসে। এদের সঙ্গে তরুণেরা সাড়া দেয়। শেষ পর্যন্ত কোন বাধাই টিকেনি। সকল বাধা উপেক্ষা করে দূর দূরান্ত থেকে ছাত্র জনতা শহীদ মিনারে এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ এসে সমবেত হয়। শুধু ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয় শহীদ মিনার যেন প্রতিবাদের মিনার হয়ে উঠে।
বাংলার আন্দোলন সংগ্রামে মানুষ শপথের জায়গা হিসেবে শহীদ মিনারকে বেচে নেয়। শহীদ মিনারে এসে মানুষ শক্তি সঞ্চয় করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নেয়। স্বাধীকার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত শহীদ মিনার হয়ে উঠে বাঙালির অন্যতম পীঠস্থান। শহীদ মিনারের পাদদেশে এসে মানুষ সমবেত হয়, একতাবদ্ধ হয়। অধিকার আদায়ের সংকল্প করে, আন্দোলন সংগ্রামের পথ খুঁজে নেয়। স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়, মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ শহীদ মিনার বাঙালি জাতিকে বারবার শক্তি যোগায় সাহস যোগায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা দেশের স্বপ্ন দেখায়। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত করে। মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতির যে বিরল দৃষ্টান্ত তাকে অনুসরণ করে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভ করে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়।
শিশু কিশোর থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষার্থী কলেজের ছাত্র–ছাত্রী সবাই যেন প্রভাতফেরীতে অংশ নিতে চায়। অনেকে ভোর রাতে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার জন্যে। মধ্যরাত থেকে শুরু হয় এদের প্রস্তুতি, প্রভাত ফেরীতে যোগ দেয়ার আয়োজন। শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র–ছাত্রীরা নানা প্রান্ত থেকে এসে প্রভাত ফেরীতে যোগ দেয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরাও। ছাত্র–ছাত্রীরা স্কুল ড্রেসে প্রভাত ফেরীতে অংশ নেয়। ভোরের শিশির ভেদ করে যখন তাদের মিছিল আসে তখন মনে হয় শত শত ফুল ফুটে আছে রাস্তায়। আর যখন মেডিকেল কলেজের নার্সদের প্রভাত ফেরীর মিছিল এগিয়ে যায়, তখন কি অপূর্ব এক দৃশ্যপট চোখের উপর ভাসতে থাকে। নিজের চোখে না দেখলে কল্পনা করা যায় না। একি অপরূপ দৃশ্য রাস্তার একপাশে হাজার ফুলের মেলা আরেক পাশে সাদা শুভ্র কাশফুলের শান্ত স্নিগ্ধ পথ চলা। যারা শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায় না বা যেতে পারে না তাদের মনেও শহীদদের প্রতি এক ধরনের ভালবাসার অনুরন অনুভূত হয়। আর যারা ভালবাসায় সিক্ত হয়ে পথের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের সবার শ্রদ্ধা ভক্তির পুষ্পার্ঘ্য বয়ে নিয়ে চলে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে এক সময়ে বই মেলা শুরু হয়। শহীদ মিনারের এপাশে রাস্তার ধারে কোন কোন তরুণ বই নিয়ে দাঁড়াতো। তাদের মাঝে বেশির ভাগই নিজের লেখা বই নিয়ে অপেক্ষা করতো। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এসে কেউ কেউ বই কিনতো। এতে লেখকের আনন্দের সীমা থাকতো না। ছোটদের বই বেশি চলতো। ধীরে ধীরে বই বিক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর জায়গা হয় না। এরা মুসলিম হলের সামনের ফাঁকা জায়গাটিতে এসে বই নিয়ে দাঁড়ায়। বিক্রিও মোটামুটি হয়। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকে। জায়গাটা জুড়ে অনেকটা বই মেলার মতো দেখায়। সকাল থেকে দুপুর এমনকি বিকেল পর্যন্ত চলে। একসময়ে একদিনের বই মেলাটি কয়েকদিন ধরে চলতে থাকে। বইপ্রেমীদের আনাগোনা বাড়ে। ধীরে ধীরে বই মেলা জমে উঠতে থাকে। বিক্রেতার সংখ্যাও বেড়ে যায়।
চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য কয়েকজন একুশের বইমেলা করার কথা ভাবেন। কয়েক বছর থেকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আর মুসলিম হলের সামনে বই বিক্রির যে আয়োজন সেটাকে মেলায় রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন। প্রথমে ছোট পরিসরে শুরু হলেও কয়েক বছরের মধ্যে বই মেলা বড় হতে শুরু করে। সপ্তাহ দশদিন পর্যন্ত বই মেলা চলে। বেশ কিছু বইয়ের স্টল মেলায় অংশ নেয়। বিক্রিও মোটামুটি হতে থাকে। বছর বছর মুসলিম হলের সামনে মেলাটি বাড়তে থাকে। স্টলের সংখ্যা যেভাবে বাড়ে দিনও বাড়ে। দশ পনের দিন মেলা চলতে থাকে। বই ক্রেতার সংখ্যা বাড়ায় বইয়ের দোকানগুলোর আগ্রহও বেড়ে যায়। লেখক পাঠকেরা নিয়মিত মেলায় আসতে শুরু করে। কোন কোন বইয়ের দোকানে লেখকেরা বসে আলাপ করে। তরুণদের সাথে সাধারণ পাঠকেরাও মেলায় আসে। এবছর থেকে পরের বছরে বইমেলা আরো জমে উঠতে থাকে। স্কুলের ছাত্র–ছাত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষের বই মেলার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে। বিকেল থেকে মেলা জমে উঠে।
একুশের বই মেলাটি ধীরে ধীরে মানুষের প্রাণের মেলা হয়ে উঠে। লেখক কবি শিল্পী সাহিত্যিক সবাই যেন মেলায় এসে অন্যরকম আনন্দ খুঁজে পায়। মেলায় প্রতিদিন নতুন নতুন বই আসতে শুরু করে। লেখকেরা বিভিন্ন স্টলে বসে পাঠকদের অটোগ্রাফ দিতে থাকে। নতুন বই কেনার এবং লেখক থেকে অটোগ্রাফ নেয়ার আগ্রহ তরুণদের মাঝে সবচেয়ে বেশি। লেখক পাঠক ও অন্যান্য সবার জন্য বই মেলাটি মিলন মেলায় পরিণত হয়। একজন লেখকের সাথে আরেকজনের হয়তো সারা বছর দেখা হয়নি। এ মেলায় এসে কিন্তু দেখা হয়ে যায়, কুশল বিনিময় হয়। সবচেয়ে বড় কথা লেখালেখির বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কেউ কবিতার বই নিয়ে আসে, কেউ গল্পের বই, কেউবা উপন্যাস বা প্রবন্ধের বই নিয়ে আসে। তবে কবিতার বই বেশি আসে। একুশের মেলায় সব ধরনের বই বিক্রি হয়। যদিওবা শিশুদের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। মা বাবারা শিশুদের বইমুখী করতে চায়। বইয়ের আনন্দে ছেলেমেয়েদের আলোকিত করতে চায়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ আর মুসলিম হলের সামনের বইমেলা একাকার হয়ে যায়। এত লোক সমাগম হয় কোথাও দাঁড়াবার ঠাঁই হয় না। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের স্রোত বাড়তে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র–ছাত্রীদের লাইন শেষ হয় না। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা ব্যানার নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। নানা পেশাজীবীরাও লাইনে এসে দাঁড়ায়। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে একের পর এক শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, শিশু–কিশোররা, তরুণেরা ফুল নিয়ে আসে। তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভালবাসা জানায়। তখন সে এক অপূর্ব দৃশ্য। সবাই এদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদের ভালবাসা আগামী প্রজন্মকেও নিয়ে আসবে এখানে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবে গভীর মমতায় ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় শহীদদের স্মরণ করে যাবে। তাদের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চলবে। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করবে না। অত্যাচার, নিপীড়ন আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সকল ভয় ভীতিকে জয় করে লাল সবুজের পতাকা চির উন্নত করে রাখবে।
একুশের বইমেলাটি এখন আর নেই। যে মেলাটি সবার কাছে প্রাণের মেলা হয়ে গিয়েছিল। যেখানে এলে লেখক পাঠক প্রাণস্পন্দন খুঁজে পেতো। সে মেলাটি কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। বই মেলাটি না থাকায় জায়গাটি কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হলও নেই। পাবলিক লাইব্রেরির বিল্ডিংও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগের পুরানো ঐতিহ্য কিছুই নেই। শহীদ মিনারটা একা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। শিশু–কিশোরের কোন পদচারণা নেই। কোন শিক্ষার্থী বা তরুণ কেউ এদিকে আসে না। কয়েক বছর থেকে এ মিনারে ফুল দেয়া হয় না। কোন জাতীয় দিবসেও না, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসেও কেউ ফুল নিয়ে আসে না। পাখিদেরও তেমন আনাগোনা নেই, তাদের ডাকও শোনা যায় না। তবে কনক্রীটের আওয়াজ শোনা যায়। ঝাঁঝালো আওয়াজ, আশেপাশে টিকে থাকা যায় না। বিশাল কর্মযজ্ঞ। মাস্টারপ্ল্যান নেয়া হয়েছে। বড় ধরনের কমপ্লেঙ গড়ে তোলা হচ্ছে। বিশ্বমানের সংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমাদের শিশু–কিশোরদের সেভাবে তৈরি করতে হবে। তবে বিশ্বের কোন দেশে শহীদ মিনার নেই। মাতৃভাষার জন্য আর কোন জাতিকে প্রাণ দিতে হয়নি। তাই আগামীর শিশু–কিশোররা যেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মূল চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলে। তা না হলে শহীদ মিনার আর হৃদয়ের মিনার থাকবে না, হয়ে যাবে কংক্রীটের মিনার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।