শহীদের রক্ত পরাভব মানে না : বিনম্র শ্রদ্ধা শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ

সমরেশ বৈদ্য | বৃহস্পতিবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

একে একে সবাই চলে গেলেন নিরাপদ আশ্রয়ে। চলে যেতে বাধ্য হলেন প্রাণ বাঁচাতে। রইলেন শুধু ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ। কিন্তু প্রচণ্ড মনোবল আর দেশপ্রেম তাঁর মধ্যে। একটিই কথা ছিল তাঁর-‘আমিতো কারো ক্ষতি করিনি, আমি এই মাটি, এই দেশ আর আমার মা ( দেবী কুণ্ডেশ্বরী)’কে রেখে কোথাও যাবো না।’ সত্যিই তিনি যাননি। অকাতরে প্রাণ দিলেন কুণ্ডেশ্বরী মায়ের মন্দিরের সামনেই। আজ ১৩ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এই উত্তাল দিনেই তিনি নিজের তাজা রক্ত এ দেশমাতৃকার বুকে ঢেলে দিয়ে প্রমাণ করলেন দেশমাতৃকার জন্য তাঁর শ্রদ্ধাভালোবাসা। তিনি আর কেউ নন। তিনি শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ। ২০১১ সালের ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য দেশের বেসামরিক সর্বোচ্চ সম্মান ‘ স্বাধীনতা পদক২০১১’ দিয়ে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছেন। ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এই শহীদের ব্যবহৃত কোট ও লাঠি সংরক্ষিত রয়েছে।

চট্টগ্রামে রাউজানে গুজরা গ্রামের এক গরীব পরিবারে ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন নূূতন চন্দ্র সিংহ। মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাতৃহারা হন। আবার আট বছর বয়সে হন পিতৃহারা। এরপর তাঁর ঠাই হয় রাউজানে জগতপুর অনাথ আশ্রমে। সেখানেই কিছুটা শিক্ষা পান তিনি। জীবনের কষাঘাতই যেন তাঁর জীবনকে মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করার দীক্ষা দিয়েছিল। সেই ছোট বেলাতেই তাঁকে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিতে হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মায়( মিয়ানমার)। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, ফল ও শরবতের দোকান এবং সাবান ও ভেষজ ঔষধ প্রস্তুতকারক হিসেবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেছেন। বেশ কিছু সঞ্চয় করেছিলেন তখন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামায় আবার সর্বসান্ত হয়ে পড়েন। ফিরে আসতে হয় দেশে। এরই মধ্যে চরম জীবনযুদ্ধ শুরু করে ১৯৪৬ সালের দিকে চট্টগ্রামের রাউজানে ও কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সাবান কারখানা ও ভেষজ ঔষধ প্রস্তুকারি প্রতিষ্ঠান কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়। এরপর এলো ১৯৪৭ এর দেশভাগ। যখন এ বঙ্গের হিন্দুরা নিজেদের ভিটেমাটি, সহায় সম্পত্তি ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছিলেন ঠিক তখন এই দেশপ্রেমিক নূতন চন্দ্র সিংহ করলেন ঠিক তার উল্টোটা। চরম সংকটের সময়ে তিনি যেনো চ্যালেঞ্জ নিলেন। আর সেই চ্যালেঞ্জ হলো তিনি অন্য হিন্দুদের মত তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ত্যাগ না করে উল্টো ফিরে এসেছিলেন সেই রাউজানেই। সম্পূর্ণ এক বৈরি পরিবেশেই তিনি কী ভেবে যে চলে এলেন, তাই এক বিষ্ময়ের বিষয়। এই যে নিজের দেশের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা, নিজের মাটির প্রতি তার প্রেম তা তিনি শুধু উনিশশো সাতচল্লিশেই দেননি তার চরম প্রমাণ দিয়েছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সময়।

কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মধ্য দিয়ে তিনি এদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা যেমন করছিলেন তেমনি সৎভাবে বিপুল অর্থও উপার্জন করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই ভেষজ বা আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের শাখা রয়েছে সারা দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে এই মহাত্মা পুরুষ তাঁর সেই অর্থ শুধু আকড়ে ধরে থাকেননি। প্রয়োজনের তাগিদে সহায় সম্পত্তি যেমন বাড়তে থাকে তেমনি তিনি মানবতার সেবায় ব্যয় করতে দ্বিধা করেননি। তখনকার দিনে রাউজানের মত এক অজপাড়াগাঁয়ে ঔষধের কারখানা যেমন করেছিলেন তেমনি শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি তার দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেনমেয়েদেরকে যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা না যায় তাহলে একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করা যাবেনা। এজন্য তিনি গড়ে তোলেনকুণ্ডেশ্বরী প্রাইমারি বিদ্যালয়, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির তথা উচ্চ বিদ্যালয় (আবাসিক), কুণ্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয় (আবাসিক)। শুধু নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠান নয়, আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন রাউজানের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অকাতরে দান করে গেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেখানে কর্তব্যরত শিক্ষকদের অনেকেই তাদের কন্যাদের শিক্ষা ও নিরাপদ আবাসের জন্য এই কুণ্ডেশ্বরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপরই নির্ভর করতেন। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সঙ্গে নূতন চন্দ্র সিংহ ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই কুণ্ডেশ্বরীতেই। পরে সেখান থেকে অনেকে দেশের ভেতরে নিরাপদ আশ্রয়ে আবার অনেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ও পরবর্তীকালেও যারা শিক্ষক ছিলেন যারা মুক্তিযুদ্ধে সময় কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের বিভিন্ন সময়কার স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেছেসেসব শিক্ষক ও রাজনীতিবিদসহ নূতন চন্দ্র সিংহের পরিবারের সদস্যদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি একটি বারের জন্যও কুণ্ডেশ্বরী ভবন ত্যাগ করতে রাজী হননি।

১৯৪৭ এর দেশভাগ (ভারতপাকিস্তান) এর সময়েও যেমন দেশপ্রেমের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় তিনি দৃষ্টান্ত রেখেছেন তেমনি আরেক মহান দৃষ্টান্ত রাখলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়। কিন্তু এই দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল আমাদের এ সমাজে। নিজের প্রাণ দিয়েই যেন দেশমাতৃকার প্রতি প্রণতি জানালেন এই ভূমিপুত্র শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যাল ও উচ্চতর আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে এই রাউজানেরই কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ( সাকা চৌধুরী) এই দানবীরশিক্ষানুরাগী অকুতোভয় নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যার জন্য দায়ী। বিভিন্ন স্বাক্ষ্যপ্রমাণে জানা যায়, পাকবাহিনী প্রথমদিকে কুণ্ডেশ্বরীতে গিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা না করেই চলে আসে। কিন্তু পরবর্তীতে সাকা চৌধুরী আবার পাকবাহিনীকে সাথে নিয়ে গিয়ে কুণ্ডেশ্বরী মন্দিরের সামনেই তাকে হত্যা করতে বাধ্য করে। এমনকি সাকা চৌধুরী নিজেও তার কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নূতন চন্দ্র সিংহকে গুলি করে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে সাকা চৌধুরী অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের হত্যাকারি। কিন্তু সবচেয়ে দুখের বিষয় হলো এমন এক মহৎপ্রাণ দেশপ্রেমিক নাগরিকের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে তাঁর পরিবারসহ এ জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর রাতে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী নূতন চন্দ্র সিংহের খুনী সাকা চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়ে। তাঁর এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হলো ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। শহীদের রক্ত পরাভব মানে না।’ মহাত্মা শহীদ অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের স্মৃতিতে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনানান আমেজে বৈশাখ
পরবর্তী নিবন্ধশ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেন ভুলে না যাই