ছোটোবেলায় বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন–উম্মে কুলসুম মুশতারী বেগম ওরফে ডলি। তিনি ১৯৩৮ সালে ১৫ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলায়। পিতা খন্দকার নজমুল হক আনসারী, মাতা আরেফা খাতুন। বাবা ছিলেন ডেপুটি পুলিশ সুপার। বাবার চাকরির সুবাদে কলকতায় বসবাস করতেন। মাত্র তিনমাস বয়সে ছোটো ডলি মাকে হারান। বাবাও ১২ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান। শিশুকাল থেকে শুরু হয় মুশতারীর জীবনসংগ্রাম। কত চড়াই–উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পরতে–পরতে ছিল বিষাদ আর সংগ্রাম। ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে যান।
১৯৫৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে দন্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শফীর সাথে মুশতারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর থেকে পরিচিত হন মুশতারী শফী নামে। কিশোরী বয়সে বিয়ে করলেও পড়ালেখা ইতি টানেননি। ডাক্তার শফী গৃহশিক্ষক রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন জীবনসঙ্গিনীকে। ছোটোবেলা থেকে ছিলেন সংস্কৃতিমনা, উচ্চাঙ্গ সংগীত, গিটার বাজাতে পারতেন বেশ ভালো। মুশতারী শফীর সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল। বাস্তব জীবনের জাঁতাকলে পড়ে লেখাপড়া অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও প্রকৃতিগতভাবে মুশতারী শফী ছিলেন তুখোড় মেধাবী মহীয়সী নারী। প্রচুর বই পড়তেন, মাত্র ১১ বছর বয়স থেকে লেখালেখি শুরু করেন। দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ছোটোদের আসর ‘মুকুলের মাহফিল’ এ ছোটোগল্প লেখার মধ্য দিয়ে লেখালেখি ও সাহিত্যজগতে বিচরণ। ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে ‘বান্ধবী সংঘ’ গঠন করা হয়। এটি ছিল চট্টগ্রামে নারীদের প্রথম সংগঠন। বলা যায় তিনি ছিলেন সে সময়ে নারীদের অগ্রপ্রতিক এক জিয়নকাঠি। চট্টগ্রাম থেকে ‘বান্ধবী’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। ১৯৬৯ সালে ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানাও চালু করেছিলেন।
১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন ‘বান্ধবী’ পত্রিকায় প্রচ্ছদ ছাপা হয় দেশের মানচিত্র, তার উপর বেয়নেটের আঘাতের ছবি। এই ছবি দিয়ে তিনি প্রতিবাদ করে বুঝিয়েছিলেন যে, এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। দেশরক্ষায় সবাইকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। সেসময় পাকবাহিনী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন ‘মেয়েদের প্রেস’।
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের এনায়েত বাজারে ‘মুশতারী লজ’ ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ স্থল । মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গোলাবারুদ মুশতারী লজে লুকিয়ে রাখতেন। এটাই মুশতারী শফির পরিবারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে ৭ এপ্রিল মুশতারী পরিবারের জন্য ছিল ভয়াবহ দিন। সেদিন রাতে পাকিস্তানিরা ডাক্তার শফী ও মুশতারীর ছোটো ভাই এহসানুল হক আনসারীকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মুশতারী শফি। তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বামী, ভাইহারা শহীদ জায়া মুশতারী শফি তাঁর ফুলের মতো ছোটো মাসুম সাত সন্তানকে নিয়ে ত্রিপুরার আগরতলা চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি পিছপা হননি, মা মাটি মাতৃভূমির টানে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। ছোটোবেলা থেকে পিতামাতা হারা এতিম এবং একাত্তরের স্বামী ও ভাইহারা জননী ধৈর্যের সাথে তিলে তিলে এক সময় মাথা উঁচু করে দাঁড়ান।
চারটিখানি কথা নয় নিজেই তিন ছেলে ও চার মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন। বলা যায় তিনি শুধু একাত্তরের জননী নন একজন রত্নগর্ভা মা–ও বটে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। সন্তানদেরকে কখনো পিতার অভাব বোধ করতে দেননি। শহীদ জায়া মুশতারী শফী সন্তানদের কাছে ছিলেন কখনো বটবৃক্ষ কখনো পিতা ও মাতা উভয়।
মুশতারী শফী শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের সহযোদ্ধা ছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মারা যাওয়ার পর শহীদ জায়া মুশতারী শফীকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। তিনি উদীচীর চট্টগ্রামে সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামে একজন আদর্শ নারী নেত্রীর মডেল হিসেবেও কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের মানুষের কাছে তিনি কখনো ছিলেন শহীদ জায়া কখনো সাহিত্যিক হিসেবে। আমার কাছে ছিলেন তিনি একজন শ্রেষ্ঠ মা, একাত্তরের এক জীবন্ত দলিল যিনি কিনা মা মাটি মাতৃভূমিকে নিজ সন্তানের মতো হৃদয় উজাড় করে অনন্তকাল ভালোবেসে গেছেন। বুকে আগলে রেখেছেন একাত্তরের স্মৃতিকে। মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন, ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও একুশের গল্প’, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’, ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’ ইত্যাদি গ্রন্থ। তাঁর প্রত্যেকটি বই একাত্তরের এক একটা প্রামাণ্য দলিল।
২০১৬ সালে শহীদ জায়া মুশতারী শফীকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলোশিপ দেওয়া হয় এবং ২০২০ সালে তাঁকে রোকেয়া পদক দেওয়া হয়। এছাড়াও তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন।
২০০৩ সাল চট্টগ্রাম জেলা প্রথম আলো বন্ধুসভায় কাজ করার সময় থেকে শহীদ জায়া মুশতারী শফীকে চিনতাম। তাঁকে আমি আন্টি বলে সম্বোধন করতাম। ২০১৫ সালে দৈনিক আজাদীতে “খোলা হাওয়া” বিভাগে শহীদ ছবুরকে নিয়ে লেখা ‘যুদ্ধ শেষে যে ছেলেটি বাড়ি ফিরেনি’ নামে শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। আমার লেখা ফিচারটি পড়ে শহীদ ছবুরের সহযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুবুর রহমান আবেগাপ্লুত হয়ে ফোনে বলেন, “বাবা রশীদ এনাম তুমি একটা বই করো”। মুশতারী আন্টির সাথে মুঠোফোনে কথা হলো তিনি আমাকে বাসায় ডাকলেন। একদিন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মুশতারী লজে গিয়ে হাজির হলাম । আমার লেখা “একাত্তরের শহিদ ছবুর” বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখে মুশতারী আন্টি মুগ্ধ হলেন। তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে পরম যত্ন করে একাত্তরের শহিদ ছবুর বইয়ের ভূমিকা লিখলেন। অনেক স্নেহ ও দোয়া করলেন আমাকে। ২০১৬ সালে বইটি বলাকা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হলে ‘মুশতারী লজে’ গিয়ে বইটি মুশতারী আন্টির হাতে তুলে দিই। তিনি অনেক খুশি হয়ে বললেন, বাবা, দেখো! শহীদ ছবুরের মতো অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জীবন ধামাচাপা পড়ে আছে। তোমার মতো যদি অন্যরা এভাবে লিখত আগামীর প্রজন্মরা শহীদ ও একাত্তরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত। মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজখবর নিতাম। ২০১৮ সালে ডায়ারি, ক্যালেন্ডার নিয়ে মুশতারী লজে গিয়েছিলাম। আন্টি অনেক খুশি হলেন। বসে অনেক গল্প করলাম চা খেলাম। এটাই ছিল মুশতারী আন্টির সাথে আমার শেষ দেখা। ২০১৯–২০২০ করোনার কারণে আন্টির বাসায় যাওয়া হয়নি। আমার লেখা একাত্তরের শহীদ ছবুর বইয়ের ভূমিকার কিছু অংশ তুলে ধরলাম:
“হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই বাংলাদেশটি আমরা নিজস্ব করে পেয়েছি। অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক তিতিক্ষা এবং পরিশেষে তিরিশ লক্ষাধিক বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির এমন একটি জায়গা ছিল না, যেখানে শহীদের রক্ত ঝরেনি এবং তাঁদের অনেকের দেহাবশেষের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত নেই। কেউ ভেসে গেছে পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলি নদীর বুকে, কেউ ভেসে গেছে অথৈ সমুদ্রের মাঝে, কেউ কেউ পাহাড়ে জঙ্গলে শেয়াল শকুনের আহার্য হয়েছে, আর কিছু সংখ্যক মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়েছে। তখন যেখানে সুযোগ হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি অজস্র গণকবর আর বধ্যভূমিতে ভরেছিল এই দেশটি। এরকম পরিস্থিতিতে গাজী আবদুস ছবুরও শাহাদতবরণ করেছেন।
আজ একাত্তরের প্রজন্ম লেখক রশীদ এনাম তুলে এনেছেন শহীদ আবদুস ছবুরকে। উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবদুস ছবুর স্মৃতি পাঠাগার ও শহীদ আবদুস ছবুর স্মৃতি ট্রাস্টের কথা এবং এই শেয়ানপাড়া গ্রামেই শহীদ ছবুরের নামে একটি ইশকুল বা কলেজ ও স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এভাবেই তাঁর স্মৃতি ও কর্মকাণ্ড প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকবে। তবে তাঁর কবর যেখানে আছে তা আরো সুন্দর সুসংহত করে যাতায়াতের সুব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই”।
(বেগম মুশতারী শফী)
২৫/১২/২০১৫
‘মুশতারী লজ’











