শহিদ পরিবারের দুঃখকথন : চাই প্রাপ্য মর্যাদা

বিচিত্রা সেন | বৃহস্পতিবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

চলছে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর। বহুল কাঙ্ক্ষিত বছর এটি বাঙালির জীবনে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীনতা পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করলো। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ধারাবাহিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালি বরাবরই স্বাধীনচেতা জাতি। যখনই কোনো বিদেশি শক্তি তার ওপর আক্রমণ করেছে,তখনই সে বিপুল বিক্রমে বাঘের শক্তি নিয়ে তা প্রতিহত করেছে। ঋষি অরবিন্দ, বাঘা যতীন থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু, সেই পথ ধরে সূর্য সেন, পরবর্তীতে শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী এবং সব শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মাথা তুলে নিজের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে পঞ্চাশ বছর ধরে।
এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। তার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা চোখে পড়ার মতো। হয়তো আরও এগুতো,কিন্তু শৈশব, কৈশোর এবং তারুণ্যের প্রথম ধাপে এ দেশকে কঠিন বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যাই হোক, যে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার জন্য বর্তমান সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে আমার আজকের এই প্রবন্ধের মূল বিষয় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ে নয়। আমার মূল উদ্দেশ্য- এই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেপথ্যে যে পরিবারগুলোর ত্যাগ, অশ্রু আর বেদনাভরা দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে তাদের কথা বলা। আমি বলছি শহিদ পরিবারগুলোর কথা।
আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললে মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলি। তাঁরা আমাদের নমস্য। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে তাঁরা দেশকে স্বাধীন করেছেন। অনেক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত থাকলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছেন, যা সত্যি প্রশংসার দাবীদার। তাঁদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছেন। এতে করে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতিনাতনিরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। জাতি দেরিতে হলেও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানিত করছে। যদিও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নন বলে বিভিন্ন সময় দাবী উঠেছে। আমরা চাই সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম সরকারি তালিকায় থাকুক। সবাই সরকারি ভাতার আওতায় আসুক। আমরা যে তিরিশ লাখ শহিদের কথা বলি তাঁদের পরিবারের একজন আমি। মুক্তিযুদ্ধে আমি হারিয়েছি আমার বাবা, কাকা এবং দুই মামাকে। তাই সেই তিরিশ লাখ পরিবারের দুঃসহ কষ্টের, যন্ত্রণার সমান ভাগীদার আমিও।
মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁরা কেউ এমনি এমনি প্রাণ দেননি। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং এ দেশীয় রাজাকার আলবদররা তাঁদেরকেই বেছে বেছে হত্যা করেছিল, যাঁদেরকে তারা পাকিস্তানের জন্য হুমকি মনে করেছিল। যারা তাদের প্রতি অনুগত ছিল তাদের তারা হত্যা করেনি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী তিরিশ লাখ শহিদই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী এবং তাঁরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আদর্শের জন্যই প্রাণ দিয়েছেন। যেমন আমি আমার বাবা, কাকাদের সম্বন্ধে বলতে পারি, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সত্তরের নির্বাচনে জনগণকে নৌকার পক্ষে ভোট দেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে মুসলিমলীগের রোষানলে পড়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের গড়া শান্তিকমিটিতে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা প্রাণ দিয়েও যথোপযুক্ত সম্মানিত হননি। মুক্তিযুদ্ধের পরে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে কীভাবে চলেছে তাঁদের পরিবার সে খবর কেউ রাখেনি। এ চিত্র শুধু আমাদের পরিবারের নয়, তিরিশ লাখ শহিদের প্রায় সবারই।
আমাদের দুর্ভাগ্য মুক্তিযুদ্ধের পরে নেতৃত্বদানকারী সরকার ছিল মাত্র সাড়ে তিনবছর। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতো। তিনি শহিদ পরিবারগুলোকে চিহ্নিতকরণ শুরু করেছিলেন। শহিদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি তাঁদের পরিবারগুলোকে স্বীকৃতিপত্র দেওয়াও শুরু করেছিলেন। যা আমরাও পেয়েছি। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দেয়নি। সপরিবারে তাঁকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে গলাটিপে তারা হত্যা করে।
যুদ্ধোত্তর দেশে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার মৃত্যুতে শহিদ পরিবারগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। একে তো স্বজনহারানোর দুঃসহ ব্যথা, তার ওপর আর্থিক অনিশ্চয়তা পরিবারগুলোকে বিপর্যস্ত করে তোলে। গভীর পরিতাপের বিষয় সেসময় রাষ্ট্র ছিল শহিদ পরিবারগুলোর প্রতিকূলে। যার ফলে শহিদ পরিবারগুলোকে লড়তে হয়েছে বৈরী পরিবেশে। তাই তাদের মূল্য দিতে হয়েছে অনেক বেশি। মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের মধ্যে পুরুষই ছিল বেশি। মহিলা ও শিশুও ছিল, তবে সংখ্যায় কম। ঘরের উপার্জনকারী পুরুষগুলো যখন নির্মমভাবে হত্যার শিকার হলো, তখন বেশিরভাগ পরিবারে রইলো শুধু নারী ও শিশুরা। তখন নারীশিক্ষার প্রসার ছিল না। সমাজ ছিল প্রচণ্ড রক্ষণশীল। সেই রক্ষণশীল সমাজে বেশিরভাগ স্বল্পশিক্ষিত নারী তাদের শিশুসন্তানদের নিয়ে কী যে বিপদে পড়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। আমার মা শিক্ষিত ছিলেন বলে হয়তো চাকরি করে তিনি আমাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সেসব শহিদের বেশিরভাগ পরিবারই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আশির দশক, নব্বইয়ের দশকে আমরা প্রায়ই মিডিয়ায় দেখতাম সেসব পরিবারের দুঃসহতম দিনযাপনের চিত্র।
দুঃখের বিষয় শহিদ পরিবারগুলো এলাকাতেও যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। এলাকার প্রশাসন এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এসব পরিবারগুলোর প্রতি বরাবরই উদাসীন ছিলেন। গুটিকয়েক পরিবার হয়তো এর ব্যতিক্রম হতে পারে। গণহত্যার শিকার শহিদ পরিবারগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার প্রধান কারণ হিসেবে যেটা দেখানো হয়,তা হলো তারা তো যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দেননি। সুতরাং তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই। এ প্রসঙ্গে এক অধ্যাপক কথাপ্রসঙ্গে বর্তমান প্রবন্ধের লেখককে বলেছিলেন, ‘গণহত্যার শিকার শহিদদের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নেই, কারণ তাঁরা গণহত্যার শিকার। তাঁরা যুদ্ধ করতে গিয়ে তো প্রাণ দেয়নি। এত লাখ লাখ শহিদের দিকে রাষ্ট্র নজর রাখতে গেলে তো ফতুর হয়ে যাবে।’ কিন্তু এসব জ্ঞানপাপীরা বুঝেও বোঝে না যে, ১৯৭১ সালে তো পুরো পূর্ব পাকিস্তানটাই যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। আর সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও শহিদদের শত ভাগই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন। আর এই সমর্থনের কারণেই তাঁদেরকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তাঁরা সবাই যুদ্ধের শিকার। তাই কোনোভাবেই তাঁদের প্রাণদানকে হালকা নজরে দেখা উচিত না। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ঢাকার যেসব বরেণ্য বুদ্ধিজীবীকে আমরা প্রতিবছর বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মরণ করি তাঁরাও কিন্তু কেউ অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি। তাঁদের যুদ্ধটা ছিল মেধা দিয়ে। তবুও তাঁদের জাতি গভীর শ্রদ্ধায় প্রতিবছর স্মরণ করে। একটা যুদ্ধে সবাই অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে না। কেউ যুদ্ধ করে কলম দিয়ে, কেউ বুদ্ধিপরামর্শ দিয়ে, কেউ খাদ্য-আশ্রয় দিয়ে। তাই কারো অবদানকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
‘গেরিলা’ সিনেমায় দেখানো হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে রাতের খাবার খাওয়াতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের হামলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলটি সহ একটি পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিলেন। তাহলে ওই পরিবারের সদস্যরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন? তাঁরা কি শহিদ নন? মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং খাদ্য দিতে গিয়েই তো তাঁরা নির্বংশ হলেন। তাহলে কেন মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের মধ্যে এত বিভাজন? বলাবাহুল্য গেরিলার ঘটনাটি কিন্তু নির্মাতা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমায় দেখানো হয়েছিল ছেলের বয়সী অপরিচিত দুই মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে এক মা তাঁর প্রতিবন্ধী অবোধ সন্তানটিকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মায়ের সামনেই সেই অবোধ প্রতিবন্ধী তরুণটিকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় হায়েনার দল। তাহলে সেই মা কি মুক্তিযোদ্ধা নন? তাঁর অবোধ সন্তানটির প্রাণদান কি তুচ্ছ? যে মা দেশের স্বাধীনতার জন্য আপন সন্তান কোরবানি দিতে পারেন, তাঁর চেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা আর কে হতে পারে? এখানে বলে রাখা ভালো উক্ত ঘটনাটি সত্য। বরেণ্য সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন যশোরে সংঘটিত সত্য ঘটনাটি নিয়ে তাঁর ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি রচনা করেন।
আমার এ লেখায় আমি মূলত বলতে চেয়েছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে তিরিশ লাখ শহিদের কথা আমরা অহরহ বলি তাঁদের পরিবারগুলোর অব্যক্ত বেদনার কথা। সে পরিবারগুলো চরম বৈরী পরিবেশে দীর্ঘকাল লড়তে লড়তে নিজেদের চাওয়া পাওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছে। প্রাণদানের কোনো প্রতিদান হয় না। শহিদ পরিবারগুলো তা চায়ও না। কিন্তু শহিদ পরিবারের সদস্যরা এটুকু তো চাইতেই পারেন, যেন তাঁদের পরিবারের প্রাণদানকারী ব্যক্তিটির নাম সরকারি গেজেটে লিপিবদ্ধ থাকে। সরকারি খাতায় যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণদানকারী প্রত্যেক শহিদের নাম থাকে। কাজটা কঠিন কিছু নয়। এলাকাভিত্তিক অনুসন্ধান চালালে তা সহজেই বের করা যাবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কাজটি শুরু করা হোক। যে জাতি তার জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী বীরদের মনে রাখে না, সে জাতি ইতিহাসের ক্ষমা পাবে না। তাই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের অঙ্গীকার হোক শহিদস্মৃতি রক্ষার। প্রতিটি শহিদ পরিবার পাক জাতির কাছ থেকে তার প্রাপ্য মর্যাদা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক; সহকারী অধ্যাপক,
বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া
পরবর্তী নিবন্ধযৌথ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজ চট্টগ্রামে