শহর থেকে দূরে

মারুফ শাহ চৌধুরী | শুক্রবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

শুক্রবার জুমার নামাজ। যেহেতু চট্টগ্রামে আছি। পিতামাতা শুয়ে আছেন রাউজান গহিরা মোবারক খীল আমাদের বড়পুকুরের পাড়ে। এটি হলো আমাদের সামনের পুকুর। কৈশোরে কত মাছ ধরা এই পুকুরে। কলা গাছের ভেলা দিয়ে পুকুরের মাঝখানে আমার জেঠাতো ভাই মিয়া বদ্দা এখন মরহুম। লম্বাচওড়া ভালো নাম দিদারুল আলম। জাল ফেলতেন। দূর থেকে গাংচিলরা আসতো। হঠাৎ করে এসে ছো করে এসে একেবারে আমাদের পুকুরের পূর্ব পাড়ে শিমুল গাছের মগডালে।

শিমুল গাছটি আর নেই, নেই মান্দার গাছ লাল লাল ফুলে এক অপূর্ব শোভা। মান্দার গাছের নিচে ময়না পাখির আনাগোনা। টোঠ টোঠ মিলানো, কিচিরমিচির শব্দ দুপুরের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে ভেঙে যেত।

বিকেলে পুকুর পাড়ে ঘাসফড়িং আনাগোনা, ভাসমান কচুরিপানায় ছোট মাকড়সার দৌড়াদৌড়ি, পানিতে ছোট ছোট বৃত্ত সেগুলি এখন হারিয়ে গেছে। দক্ষিণ পাড়ে দুটি জোড়া কাঁঠাল গাছ। তাদের একটি বড় শিকড় পানিতে নেমে গেছে। আমি ছোট অপু শিকড়ের উপর বসে দক্ষিণা বাতাসে পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ সৃষ্টি হতো তা দেখতাম। মনে হতো আমি একটি জাহাজে বসে আছি। আমার মনে হতো আমি ছোট একজন নাবিক।

জাহাজটি এগিয়ে চলছে। পৃথিবীর পথে। আমার ছোট্ট ভুবন, আমার পৃথিবী। আমি ছোট সিন্দাবাদ। আমি বসে আছি, আর পুকুরের ছোট ঢেউয়ের সাথে, আমার ছোটবেলার ভূবন আমার সাথে এগিয়ে চলছে। আমার পৃথিবী নামক জাহাজটি অনেক পুরানো হয়ে গেছে। পুকুরের ঝোপ ঝাড়ে সন্ধ্যাবেলায় সে ডাহুক হঠাৎ ডাক আর শোনা যায় না। সকালবেলায় কয়লা দিয়ে দাঁত মেজে মেজে যখন পুকুর ঘাটে যেতাম, পুকুরের পাশে হিজল তমাল গাছে ছোট্ট মাছরাঙা পাখিটি আর দেখা যায় না। সন্ধ্যা বেলায় বাড়ির দক্ষিণ পাশে যখন তাকাতাম শত জোনাকি পোকার স্নিগ্ধ আলো আর দেখা যায় না। আমাদের টিনের ঘর গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

যেখানে লুকিয়ে ছিল আমাদের শৈশব, এখন সবখানে পাকা দালান। কোন কোন গ্রামের বাড়িতে এসি। মনে পড়ে যায় জোসনা রাতে দাদি বাড়ির উঠোনে পাটি বিছিয়ে নাতিদের হাত পাখা দিয়ে আমাদের বাতাস দিতেন।

কখনো কখনো চন্দ্রগ্রহণ, দাদির আফসোস একটি পয়সা কর্য নিয়েছিল এবং তা দিতে পারে নাই বলে চাঁদের এই অবস্থা। একসময় পুরো পূর্ণিমার চাঁদটি হারিয়ে যেত। দাদি তখন আমাদের কিছু খেতে মানা করতেন। মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হতো। আমাদের একটি সামিয়ানা ছিল গ্রামের বিয়েশাদীতে ফ্রি দেওয়া হতো।

দাদী কাজ শেষ হলে ওটা একটি বস্তায় আমাদের বাড়ির ছাদে আটকিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে এটি এদিক ওদিক দোল খেত। তখন মনে হতো ভূমিকম্প হচ্ছে। বাড়ির উঠানে আযানের ধ্বনি আল্লাহু আকবার। এক সময় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতো। রাত্রে শিয়ালের ডাক, কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকার। তারপর মা দাদিদের চিৎকার করে বলে ওঠা লে লে। সমাগত চিৎকারে বন বিড়াল, শিয়াল পালিয়ে যেত। আজ কোন ঘন জঙ্গল নেই। আমাদের পিছনের পুকুরে হঠাৎ একটি বিরাট গুইসাপ পানি দুভাগ করে চলে যেত। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বিরাট কড়ই গাছ। তারই মগডালে একটা হুতুম পেঁচা চুপ করে বসে থাকতো। আমি ভয় পেয়ে যেতাম। দাদির আঁচল তুলে মাথা ঢুকাতাম। এক সময় বর্ষা, আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো। টিনের চালের ছন্দময় বৃষ্টির শব্দে ঘুম চলে আসতো। কোন বিয়েতে মাইকের গান মালকা বানুর দেশের গান শোনা যেত। আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম একটি নতুন সকালের জন্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষকদের সম্মান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব
পরবর্তী নিবন্ধইস্তেগফারের কুরআনীয় কনসেপ্ট: বিশ্ব মুসলিমের জন্য মুক্তির বার্তা