কক্সবাজারের চকরিয়ার উপকূলীয় সাতটি ইউনিয়নের প্রায় সাত হাজার একর জমিতে চাষাবাদে একমাত্র মিঠাপানির উৎস হচ্ছে ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল (বুড়া মাতামুহুরী)। ২০০ একরের প্রায় ছয় মাইল দীর্ঘ এই জলমহালটি ১১ বছর আগেও এখানকার কৃষকের জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই ছিল। পরবর্তী সময় থেকে এই জলমহালটি জেলা প্রশাসন তিন বছর পর পর মিঠাপানির মৎস্য চাষের জন্য ইজারা দিয়ে আসছে। এর পর থেকেই অভিশাপে পরিণত হয়েছে জলমহালটি।
সর্বশেষ ২০২০ সালে জলমহালটি তিন বছরের জন্য ইজারা পায় জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি। এটির পরিচালক হচ্ছেন মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক কমিটির সদস্য দলিলুর রহমান।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া ইজারায় শর্ত রয়েছে, এই জলমহালে কোনোভাবেই সামুদ্রিক লবণ পানি ঢোকানো যাবে না। কিন্তু প্রতিবছর আমন মৌসুমে ইজারাদার শর্ত অমান্য করে বেশি লাভের আশায় স্লুইস গেটের জলকপাট খুলে দেওয়ায় সামুদ্রিক লবণ পানিতে এখন টইটম্বুর হয়ে রয়েছে।
এই অবস্থায় উপকূলীয় বদরখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, কোনাখালী, বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা ও সাহারবিল ইউনিয়নের প্রায় সাত হাজার একর জমিতে রোপিত ধান, রকমারী সবজি ক্ষেত মিঠা পানি না পেয়ে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগী কৃষকদের অভিযোগ, বর্ষায় পানি আটকে রেখে প্রায় সাত হাজার একর জমির আমন চাষের ক্ষতি করেন ইজারাদার। এনিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগকে বার বার জানানো হলেও কোনো কাজই হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে চলতি আমন মৌসুমে খাদ্যশস্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। আর্থিকভাবে বিরাট মার খাবে এখানকার অন্তত ৩০ হাজার কৃষক।
উপকূলীয় ইউনিয়ন বদরখালীর সাতডালিয়া পাড়ার কৃষক নেজাম উদ্দিন, কোনাখালীর জাফর আলম, পূর্ব বড় ভেওলার ছিদ্দিক আহমদ, পশ্চিম বড় ভেওলার সফকাত হোসেনসহ অসংখ্য কৃষকের ভাষ্য, বাপ-দাদার আমল থেকেই তারা মাতামুহুরী নদীর প্রশাখা বুড়া মাতামুহুরীর (ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল) মিঠা পানি দিয়ে প্রাত্যহিক জীবনাচার, মাছ ধরা, চাষাবাদ করাসহ নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। এই জলমহাল ছিল সর্বসাধারণের জন্য একেবারেই উন্মুক্ত। কিন্তু প্রায় এক যুগ আগে থেকে নামেমাত্র রাজস্ব নিয়ে এই জলমহালটি তিন বছরের জন্য ইজারা দেওয়ায় কৃষকের কপাল পুড়ছে। প্রতিবছর মিঠাপানির উৎস ধ্বংস করা হচ্ছে লবণ পানি ঢোকানোর কারণে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃষকদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা।
তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোর প্রায় ৩০ হাজার কৃষক ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালের মিঠা পানি ব্যবহার করে থাকেন। একদিকে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানির প্রভাব ও অপরদিকে অনাবৃষ্টিতে দিশাহারা কৃষকের মিঠাপানির উৎস ছিল এই জলমহাল। কিন্তু অতিলোভী প্রভাবশালী ইজারাদার চিংড়ি চাষ করতে স্লুইস গেটের জলকপাট খুলে দিয়ে সমগ্র খালের পানি লবণাক্ত করে ফেলেছে। পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় জমিতে রোপিত ধানের চারা মরে যাচ্ছে। হাহাকার শুরু হয়েছে উপকূলের কৃষকদের মাঝে।
পরিকল্পিতভাবে কৃষকদের এই ক্ষতির দায়ভার নেবে কে? এই পশ্ন্ন তুলে ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, দ্রুতসময়ে মাতামুহুরী নদীর পালাকাটা রাবার ড্যামের (ব্যারেজ) রাবার ফুলিয়ে ‘ফুরইন মারা খাল’ দিয়ে মাতামুহুরী নদীর মিঠা পানি ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে প্রশাসনকে। তা করা না হলে উপকূলের ৩০ হাজার কৃষক পরিবার সন্তান-সন্ততি নিয়ে পথে বসবে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবার তলানীতে যাবে।
সরজমিন উপকূলীয় একাধিক ইউনিয়ন ও ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়নে দিগন্তজোড়া ধানের জমিতে রোপিত চারা মিঠা পানি না পেয়ে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লবণ পানির কারণে গবাদি পশুসহ ১০টি গ্রামের লোকজন সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লবণাক্ত পানির কারণে খোদ জলমহালের পানিতে ভাসতে থাকা কচুরিপানাও পুড়ে লাল-কালচে হয়ে মরে যাচ্ছে।
উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সমুদ্র উপকূলের সাথে লাগোয়া ছড়াখালগুলোর ওপর নির্মিত বেশ কয়েকটি স্লুইস গেটের নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের হাতে নেই। সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ দুর্বৃত্তদের হাতেই। তারা যাচ্ছেতাই অপব্যবহার করছে স্লুইস গেটগুলোর। সঠিক তদারকি না থাকায় পুরো উপকূলজুড়ে এই ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে।
তবে ঢেমুশিয়া জলমহালের ইজারাদার আওয়ামী লীগ নেতা দলিলুর রহমান বলেন, আমি স্লুইস গেটের জলকপাট খুলিনি এবং কোনো লবণ পানিও ঢোকাইনি। এই জলমহালের চারিদিকে হচ্ছে লবণমাঠ। তাছাড়া বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উজান থেকে ভাটির দিকে পানিও নামেনি। তাই এমনিতেই পুরো জলমহালের পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, একদিকে অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে সামুদ্রিক লবণ পানির প্রভাবে এমনিতেই কৃষকের দুর্বিষহ অবস্থায়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে ঢেমুশিয়া জলমহালে লবণ পানি ঢোকানো খুবই দুঃখজনক। তাই আগামীতে এই জলমহাল যাতে ইজারা দেওয়া না হয় সেজন্য কৃষিবিভাগের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনে পত্র দেওয়া হবে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ইজারার শর্ত ভঙ্গকারীর বিষয়ে জেলা প্রশাসনে লিখিতভাবে জানানো হবে। একইসাথে ঢেমুশিয়া জলমহালের লবণ পানি যাতে ভাটির দিকে নেমে যেতে পারে সেজন্য মাতামুহুরী নদীর ওপর নির্মিত ‘বাঘগুজারা’ ও ‘পালাকাটা’ রাবার ড্যামের রাবার ফুলানো হবে। দু-একদিনের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি হলেই উপকূলের সাত ইউনিয়নের কৃষকদের আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না সেচ সমস্যা নিয়ে।