‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ/ নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ ঋতুসংহার কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে লিখেছিলেন মহাকবি কালিদাস। সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাস তাঁর লিরিক্যাল পোয়েম বা খণ্ডকাব্য ‘মেঘদূত’ এর জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন।
নির্বাসিত এক যক্ষ মেঘকে দূত করে প্রিয়ার কাছে বার্তা পাঠায়। এই কাহিনিকে ঘিরে লিখেছেন তিনি ‘মেঘদূত’ কাব্য।
‘কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুল্ল পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের নিক্বন, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহবল্লরী, অপরূপ যার আকৃতি, সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’
বাংলা সাহিত্য জগতে মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। বর্ষাকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। সেই থেকে বাংলা সাহিত্যে বর্ষা একটি নান্দনিক উচ্চারণ। তিনি বর্ষার মতো শরৎবন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী।
মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাস ‘ভাদর মাস’ নামে তাঁর একটি পদে লিখেছেন–
‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি অন্ধকারে
শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল
তাত না দেখিবোঁ যঁবে কাহ্নাঁঞির মুখ
চিনিতে মোর ফুট জায়িবে বুক।’
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনকাব্যে শরতের উল্লেখ পাওয়া যায় বারবার। মঙ্গলকাব্যে ঋতুচিত্র আঁকার সময় কবিরা শরতের ঝকঝকে আকাশ ও পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন।
‘বৈষ্ণব পদাবলী’র কবিরাও শরতের রাত, বিশেষত শরৎ পূর্ণিমায় রাধা কৃষ্ণের লীলা বা ভক্তিগীতি রূপায়িত করেছেন। কৃষ্ণ লীলা নিয়ে রচিত অনেক পদে শরতের চাঁদের আলো এক বিশেষ আবহ তৈরী করেছে।
শরতের পূর্ণিমা এক অপূর্ব রাত। এই রাতকে কোজাগরী পূর্ণিমার রাত বলে অভিহিত করা হয়। এই রাতকে প্রেম, রহস্য, আধ্যাত্মিক অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকেই সাহিত্য রচনা করেছেন। এককথায় বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি কবি, সাহিত্যিক শরৎ কালকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
শ্রাবণ শেষের দিনগুলোতে আলোর নবরেখা উন্মোচিত হয় শরতের হাত ধরে। শ্রাবণের অঝোরে ঝরে পড়াতে ছেদ পড়ে হুট করে প্রকৃতির মধ্যে আসে আদুরে পরিবর্তন। আকাশে এক নতুন আলো খেলা করে। বাতাসে কেমন যেনো এক টান অনুভব হয়। তাতে মনে এক উৎসবের আমেজ জেগে ওঠে। প্রকৃতির এই সুপ্ত পরিবর্তন প্রকৃতিকে নতুন করে চেনাতে শেখায়।
সোনারঙা রোদে ঝলমলে হয়ে ওঠে পৃথিবী। সোনালি দিনগুলোর সূচনা ঘটে শরতের মাধ্যমে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ প্রাণ বর্ষায় সিক্ত হয়। বর্ষার মন্দাক্রান্তা পার হয়ে প্রকৃতি শরতে পদার্পণ করে আর জন জীবনে নেমে আসে অনাবিল প্রশান্তি। জীবনে নতুন আলোকরেখা দেখা দেয়। প্রকৃতি সুসজ্জিত হয় নতুন রূপে, নতুন গন্ধে। প্রকৃতি আর মানবমনের এই যে যোগসূত্র তা অনায়সে সাহিত্যে স্থান করে নেয়।
জীবনের যে কোনো অনুষঙ্গই সাহিত্যের অংশ হতে পারে। শরৎ নিয়ে তাই বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে সেই অনাদিকাল থেকেই। কালিদাস পরবর্তী রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারের মতো সচকিত উচ্চারণে শরৎকে উপস্থাপন করেছেন বাংলা সাহিত্যে।
শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি প্রকটিত হয়েছে। তিনি শরতের শান্ত, স্নিগ্ধ রূপ, শিউলির ঝরে পড়া, কাশবনের সৌন্দর্য, সাদা মেঘ আবার ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রূপ বদলকে ভালোবেসেছেন আর তাঁর সেই ভালোবাসাটুকু ফুটে উঠেছে তাঁর সাহিত্যে। তাঁর এই ভালোবাসাটুকু আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছে আপামর বাঙালির অন্তরে, যাতে তিনি লাভ করেছেন মুক্তির অপার আনন্দ।
বর্ষার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সোনালি সুদিনের জন্য যে আকুল আকাঙ্ক্ষা, তাতে তিনি ডানা মেলে উড়তে চেয়েছেন। মূলত বর্ষার মন্দাক্রান্তা পেরিয়ে আসন্ন শীতের জরাজীর্ণতার মধ্যখানে এই অপার সোনালি সুদিন কবির অন্তরাত্মা কে জাগ্রত করেছে। তাই বাংলা সাহিত্যে শরৎ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে ভাবনাটুকু তাতে শরৎকে। নিছক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে নয় বরং মানব মনের একটি বিশেষ রূপ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের শরৎ বন্দনা সর্বজন স্বীকৃত। শরতের আকাশের নীলে আর সাদা মেঘের ছুটে বেড়ানো দেখে তিনি এতটাই উচ্চসিত হয়েছিলেন যে তখন তিনি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালেই রচনা করলেন শরৎ মাহাত্ম্য–
‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাড়িয়ে মোহন অঙ্গুলি।
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলি!’
বর্ষার অবিরাম জলধারায় প্লাবিত হয়ে ঝকঝকে তকতকে শরীর নিয়ে প্রকৃতি পা ফেলে শরতের পথে। শরৎ তাই একটু বেশিই পরিশুদ্ধ অন্যান্য ঋতু থেকে। শরতের শেষ প্রসঙ্গে এসে ধীরে ধীরে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু জমে ওঠে, বাতাস হয়ে যায় শীতল, মনে জাগে নতুন ছন্দ, গন্ধ, রং।
রবীন্দ্রনাথ না থাকলে বাঙালি শরতের এত রূপ বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে পারতো কখনো? তিনি শরৎকে বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল আর সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে।
বিখ্যাত কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন এভাবে –
‘শরতের দ্বিপ্রহরে
সুধীর সমীর–পরে,
জল–ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায় ;
ভাবি, একদৃষ্টে চেয়ে –
যদি ঊর্দ্ধপথ বেয়ে
শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্রভেদী ধায় ’!
এখানে কবি রূপক অর্থে গ্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনের একটি ধারাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
নজরুল ইসলাম গানে গানে শরৎ কে নিয়ে গেছেন সর্বসাধারণের হৃদয়ের গহীনে।
‘শিউলি ফুলের মালা দোলে
শারদ রাতের বুকে ওই!’
অথবা,
‘শিউলি তলায় ভোর বেলা
কুসুম কুড়াই পল্লী বালা!’
শরৎ মানে শিউলির সুগন্ধ নাকে ভেসে আসা। এই এক অসাধারণ অনুভূতি, চোখ বন্ধ করলেই যেন নাকে ভেসে আসে এই সুগন্ধি। শিউলির মতোই চমৎকার ফুল নিয়ে গ্রীক ও ভারতীয় নানা রূপকথা বিরাজমান। সুসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বিস্তৃত শিউলী বন ও তার তীব্র সুগন্ধির কথা উল্লেখ করেছেন। তাতে শরৎ প্রকৃতির নানা উদাহরণের মধ্যে সাথে সাথে স্থান পেয়েছে অসাধারণ শরতে তাঁর মনোজাগতিক পরিবর্তনের কথা।
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের এক এবং অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। আদি সাহিত্য চর্যাপদের অধীশ্বর থেকে আধুনিক কালে নবীনতম রচনায়ও শরৎকাল তার নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত।
কবি জসীমউদ্দীন শরৎকে দেখেছেন একান্ত নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যের একটি অংশে শরৎকালের বিরহ ও প্রতীক্ষার চিত্র এঁকেছেন তিনি এভাবে
‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।
আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা।’
যদিও জীবনানন্দ নির্জনতার কবি। তিনি হেমন্তকে বাংলা সাহিত্যে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্বতায়। হেমন্ত আলোয় আলো হয়ে উঠেছে তাঁর সাহিত্যে। তবুও তিনি শরতের আকাশে এক অদ্ভুত আলো দেখেছেন।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় তিনি লিখেছেন
‘এখানে আকাশ নীল নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুলফুটে থাকে হিম শাদা রং তার আশ্বিনেলর আলোর মতন’!
কবি শামসুর রাহমান, আধুনিক কবি। তিনিও শরৎ চর্চা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন নি। ‘শরত আলোর কমল বনে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন–
‘কোথায় শিউলিতলা, সেই কবেকার ভোরবেলা
যখন কুড়িয়ে ফুল, পেরিয়ে শিশিরভেজা পথ
বসতে পুকুরঘাটে, দৃষ্টি মেলে দিতে তুমি দূর বহুদূর
বনানীর দিকে অথবা সাঁতার কেটে
কাটত তোমার বেলা কারো কথা ভেবে নিরালায়?’!
আবার ‘শরৎ’ কবিতায় শরতের প্রতি এই আহ্বান রেখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ–
‘হে শরৎ, তুমি তোমার উদ্ধত সূর্যের উত্তাপে
নির্মল ঝিলের স্মৃতিগুলো আকাশে মিলিয়ে দাও;
আর আমি স্মৃতির দংশন থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচি।’
একমুঠো মিষ্টি আদুরে রোদ নিয়ে শরতের উপস্থিতি। উৎসবে, বৈচিত্র্যে, আলোয়, শিশিরে, শিউলিমালায়, আকাশের নীলে, দেবীর আরাধনায়, ধুনুচি নাচে, বসর্জনের বেদনায় সিক্ত হয় শরৎ। শরৎ ধরা দেয় সাহিত্যে, আর সাহিত্য মানবমনের খোরাক মিটায়। শরৎকে ভালোবাসতে পারলে হৃদয় সমৃদ্ধ হয়। শরৎ ঋতুবৈচিত্র্যে উজ্জ্বল একটি ধারা, যার আলোয় আলো হয়ে থাকে বিশ্বপ্রকৃতি!
লেখক: প্রাবন্ধিক।