বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠালগ্নে ২৫০ শয্যা দিয়েই যাত্রা শুরু এ হাসপাতালের। পর্যায়ক্রমে ২০১২ সালে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ১৩১৩–এ উন্নীত হয়। সর্বশেষ গতবছর (২০২২ সালে) এ হাসপাতাল ২২’শ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। ১৩১৩ থেকে ২২’শ শয্যায় উন্নীতকরণ ও বর্ধিত শয্যায় সেবা চালুকরণে ২০২২ সালের ২৫ মে অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শওকত উল্লাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর ২২’শ শয্যায় উন্নীতকরণে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা–১ শাখার উপসচিব উম্মে হাবিবা কর্তৃক ১৪ জুন (২০২২ সালের) স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে প্রশাসনিক অনুমোদনের এ তথ্য জানানো হয়। শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সে অনুপাতে হাসপাতালের বাজেট–বরাদ্দ, জনবল সবই বাড়বে বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। আর বাজেট–বরাদ্দ ও জনবল বাড়লে চিকিৎসা সেবার পরিসরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছিলেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি– ধাপে ধাপে শয্যা সংখ্যা বাড়লেও ৫০০ শয্যার জনবলেই (চিকিৎসকের সংখ্যা বাদ দিয়ে) সেবা দিয়ে আসছে এ হাসপাতাল।
যদিও প্রতিনিয়ত আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকছে হাসপাতালে। এছাড়া দৈনিক আরো প্রায় তিন হাজার রোগী বহিঃ বিভাগে সেবা নিয়ে থাকেন। ফলে সীমিত (৫০০ শয্যার) জনবলে তিন হাজার রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয় হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২২’শ শয্যার প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পর এবার জনবল সংকট কাটাতে উদ্যোগী হয়েছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। উদ্যোগের অংশ হিসেবে নতুন জনবল কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রস্তাবনা আকারে নতুন এই জনবল কাঠামো এরই মাঝে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের স্বাক্ষরে গত ৩০ মার্চ এ প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও এর অনুলিপি দেয়া হয়েছে।
যা আছে প্রস্তাবনায় : ঢাকায় পাঠানো জনবল কাঠামো পর্যালোচনায় দেখা যায়– বর্তমানে চিকিৎসকসহ সবমিলিয়ে হাসপাতালের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ২ হাজার ৩৪৯টি। আর চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারী, রেডিওলজিস্ট, টেকনোলজিস্টসহ সবমিলিয়ে ২ হাজার ৫২৭টি নতুন পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এসব পদ অনুমোদন পেলে হাসপাতালের মোট পদের সংখ্যা দাাঁড়াবে প্রায় ৫ হাজারে (৪ হাজার ৮৭৫টিতে)।
নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রস্তাবনা : প্রস্তাবিত জনবল কাঠামোয় ব্যতিক্রম দিকের মধ্যে হাসপাতালের নিজস্ব জনবল হিসেবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে এবার। অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক মর্যাদার যথাক্রমে চিফ কনসালটেন্ট ও সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে চার শতাধিক (৪৪৪টি) পদ সৃজনের কথা বলা হয়েছে।
এর মধ্যে অধ্যাপক সমমানের চিফ কনসালটেন্ট হিসেবে ১৭৪টি এবং সহযোগী অধ্যাপক সমমানের সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে ২৭০টি পদ প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন– সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পর্যায়ের প্রায় হাজার খানেক শিক্ষক–চিকিৎসক রয়েছেন। তবে তারা হাসপাতালের নিজস্ব চিকিৎসক নন। এসব চিকিৎসক মেডিকেল কলেজের অধীনস্থ। মেডিকেল কলেজ থেকেই তারা বেতন–ভাতা উত্তোলন করেন। ফলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত এসব চিকিৎসককে একাডেমিক সময়ের বাইরে (দুপুর ২টার পর) হাসপাতালের ওয়ার্ডে খুব একটা দেখা যায়না। যার দরুণ দুপুরের পর হাতে গোনা দুয়েকজন মেডিকেল অফিসার এবং ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই মূলত চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন হাসপাতালের ওয়ার্ডে। রোগী ও স্বজনদের এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। রাতের বেলায় ওয়ার্ডে চিকিৎসক খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগও কম নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালের নিজস্ব ডাক্তার হিসেবে রয়েছেন জুনিয়র পর্যায়ের কিছু চিকিৎসক। বিশেষ করে মেডিকেল অফিসার পর্যায়ের এসব চিকিৎসক দিয়ে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া হাসপাতালের নিজস্ব হিসেবে জুনিয়র পর্যায়ের চিকিৎসকের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। সবমিলিয়ে দুুপরের পর হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে বাস্তবিক অর্থেই হিমশিম অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাপক পর্যায়ের চিফ কনসালটেন্ট এবং সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের সিনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে নিজস্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ সৃজনে প্রস্তাবনা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের এসব পদ সৃজন হলে পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। হাসপাতাল পরিচালকের মতে, নিজস্ব চিকিৎসক হিসেবে প্রস্তাবিত চার শতাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া গেলে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবায় আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। কারণ, তখন রোস্টারের মাধ্যমে ২৪ ঘন্টাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এর মাধ্যমে রোগীদের প্রত্যাশিত বা অনেকটাই সন্তোষজনক সেবা দেয়া সম্ভব হবে।
এদিকে, মধ্য পর্যায়ের চিকিৎসক হিসেবে হাসপাতালে বর্তমানে জুনিয়র কনসালটেন্টের পদ আছে মাত্র দশটি। নতুন জনবল কাঠামোতে জুনিয়র কনসালটেন্টের আরো ২৪২টি পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান ১০২টি মেডিকেল অফিসার পদের স্থলে আরো ৩২৮টি পদের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। ১১–১৭ গ্রেডের মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য পদে বিদ্যমান ১৮৮টির স্থলে নতুন আরো ২৬০টি পদ সৃজনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান ৩৪১টি ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদের স্থলে নতুন করে আরো ২৩০টি পদের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বর্তমানে ২৬৩টি পদ রয়েছে। জনবল কাঠামোতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আরো ৪৪৫টি পদ সৃজনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের প্রশাসনিক পদেও নতুন করে পদ সৃজনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে জনবল কাঠামোতে। বিদ্যমান একটি মাত্র উপ–পরিচালকের পদ বিলুপ্ত করে তিনজন উপ–পরিচালক (প্রশাসন, অর্থ ও ভান্ডার, হাসপাতাল) চাওয়া হয়েছে। সহকারী পরিচালকের বিদ্যমান ২টি পদের স্থলে আরো ৭টি যুক্ত করতে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া লিগ্যাল অফিসার, এস্টেট অফিসার, জনসংযোগ কর্মকর্তাসহ নতুন করে বেশ কয়টি পদ সৃজনের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে হাসপাতালের জনবল কাঠামোতে।