অভিনব কৌশলে বেড়ে চলেছে প্রতারণা ও ছিনতাই। অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টি কৌশল বদলে প্রতারণা ও ছিনতাইয়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ‘মাইন্ড কন্ট্রোল ড্রাগ’। এটি ‘ডেভিলস ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বা ‘স্কোপোলামিন’ হিসেবেও পরিচিত। এ পন্থায় একজন প্রতারক কিংবা ছিনতাইকারী ভুক্তভোগীকে চাইলেই কাবু করে নিজের ইশারায় নাচাতে পারে। প্রতারক যে নির্দেশনাই দেবে, তা–ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সেই নিরীহ ভুক্তভোগী। বিষয়টি জাদুটোনার মতোই কাজ করে। সর্বশেষ গত ২২ মে মো. জনি নামে এ ধরনের অপরাধী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর স্কোপোলামিন ব্যবহারের চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় নগর পুলিশ। নগরবাসীকে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ থেকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, ফাতেমা বেগম নামের এক নারী অপরাধী চক্রটির সদস্যদের পেছনে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাঁদের কথামতো নিজের কানের দুল, গলার চেইন খুলে দিচ্ছেন। যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। স্বর্ণালংকার ছাড়াও নিজের কাছে থাকা এক হাজার টাকা, মুঠোফোন ও বাজারের ব্যাগও দিয়ে দেন। দেখে মনে হচ্ছে, অপরাধীরা তাঁর পূর্বপরিচিত। পুলিশ বুঝতে পারে, ফাতেমার নাকের কাছে স্কোপোলামিন বা বুদ্ধিনাশক ওই রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
ভুক্তভোগী ফাতেমা বেগম বলেন, সেদিন আমি তাদের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম। তারা যা বলেছে, তা–ই করেছি। পরে বাসায় আসার পর আমি বিষয়টি বুঝতে পারি। স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে আলাপ করে থানায় মামলা করি। আমার মতো আর কেউ যাতে এই প্রতারণার শিকার না হন। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ ধরনের ঘটনা এখন নগরীর প্রতিটি এলাকায় প্রায়ই হয়ে থাকে। আর এ অপরাধ সংঘটিত করতে ব্যবহার করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ বা ‘স্কোপোলামিন’। ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’ একটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এটি মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দুর্বৃত্তরা লোকজনকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিতে এটি ব্যবহার করে। এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুণ বেশি। অন্যের আদেশ পালন করতে বাধ্য করানোই হলো এ মাদকের মূলমন্ত্র। ভুক্তভোগীরা হেপনোটাইজ হয়ে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান। নানাভাবে ও নানা কৌশলে এটি প্রয়োগ করা হয়। যেমন: হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে, ঘ্রাণের মাধ্যমে, খাবারের সঙ্গে, চিরকূটের মাধ্যমে, কোমল পানীয়ের সঙ্গে, বাতাসে ফুঁ দিয়ে। স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই ফরমেটেই পাওয়া যায়। এ ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে, যার প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু–তিন দিন।
কীভাবে কাজ করে ‘ডেভিল ব্রেথ’ পার্টি : স্কোপোলামিন মাদক ব্যবহারের কারণে ছিনতাইকারীদের মতো ছুরি, চাকু বহন করা লাগে না এই পার্টির সদস্যদের। এমনকি পকেটমারদের মতো ধরা পড়া বা গণপিটুনি খাওয়ার ঝুঁকিও থাকে না তাদের। প্রথমে এই পার্টির এক সদস্য তার টার্গেটেড লোকের কাছে গিয়ে একটি কাগজ বা মোবাইলের মেসেজ দেখিয়ে ঠিকানা জানতে চায়। আবার কোনো এক রিকশাওয়ালা একটি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বলবে– বাবা, এই প্রেসক্রিপশনের ওষুধের নামটা কী? কোথায় পাওয়া যাবে? মানবিক বোধ থেকে তাদের সাহায্য করতে গিয়েই প্রতারণার ফাঁদে পড়েন সাধারণ মানুষ। মূলত কাগজের মধ্যে থাকে স্কোপোলামিন ওষুধ। তাদের দেওয়া কাগজ, ফোন বা অন্য কিছু নাক ও চোখ মুখের কাছাকাছি ধরার সময় শ্বাসের মাধ্যমে স্কোপোলামিন গ্রহণ করে ফেলবেন। মুহূর্তের মধ্যে চিন্তাশক্তি অকার্যকর হয়ে হিপনোটাইজড হওয়া এবং ভিকটিমের সঙ্গে থাকা টাকা–পয়সা, গহনা, মোবাইলসহ সব কিছু দিয়ে দেন ভয়ঙ্কর ‘ডেভিলস ব্রেথ’ পার্টির সদস্যের হাতে।
সিআইডির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দিলীপ কুমার সাহা মনে করেন এই ড্রাগ ব্যবহারকারী প্রতারক বা ছিনতাইকারীদের হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতা এবং সতর্কতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব সর্তকতার জন্য কিছু টিপসও দেন তিনি। ১. রাস্তাঘাটে অপরিচিত সবার থেকে সবসময় সর্তক থাকা। অপরিচিত লোকের কোনো কিছুতে হাত দেওয়ার পূর্বে প্রয়োজনীয় প্রটেকশন নেওয়া, ২. মাস্ক ব্যবহার করা, ৩. ব্যক্তিগত আইটেম/ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, যেমন–নিরাপদ পানীয় এবং খাবার–দাবার খেতে সন্দেহ আছে এমন কোনো খাবার খাওয়া যাবে না এবং অপরিচিতদের কাছ থেকে খাবারসহ কোনো অবজেক্ট/আইটেম সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে গ্রহণ করা যাবে না, ৪. স্কোপোলামিন অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার জন্য সতর্কতাগুলোর মধ্যে আরেকটি হলো– সচেতনতা এবং শিক্ষা; স্কোপোলামিনের বিপদ এবং কীভাবে এটি পরিচালনা করা হয় (সাধারণত ইনজেশন, ইনহেলেশন বা ত্বকের মাধ্যমে শোষণের মাধ্যমে) সে সম্পর্কে নিজেকে এবং অন্যদের জানাতে ও সচেতন করতে হবে; ৫. সন্দেহজনক আচরণ প্রদর্শনকারী ব্যক্তিদের থেকে সতর্ক থাকুন, বিশেষ করে যারা আপনাকে পদার্থ গ্রহণে বা তাদের নির্দেশাবলী অনুসরণ করার জন্য জোর বা চাপ দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের সঙ্গে ভ্রমণে সতর্ক থাকতে হবে; ৬. কম আলো বা বিচ্ছিন্ন এলাকায় একা হাঁটা এড়িয়ে চলুন এবং অপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় সতর্ক থাকুন, বিশেষ করে নাইট লাইফ বা পর্যটন এলাকায়; ৭. আপনার জিনিসপত্র বা খাদ্য সরবরাহের সঙ্গে অননুমোদিত অ্যাক্সেস এবং সম্ভাব্য কারচুপি প্রতিরোধ করতে আপনার বাসস্থানকে সুরক্ষিত রাখুন; ৮. যদি আপনার সন্দেহ হয় যে আপনি স্কোপোলামিন বা অন্য কোনো ক্ষতিকারক পদার্থের সংস্পর্শে এসেছেন, অবিলম্বে চিকিৎসাসেবা নিন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি দ্রুত রিপোর্ট করতে হবে।