শবে বরাত তাৎপর্যময় রজনী

ড. আ. ম. কাজী মুহাম্মদ হারুন উর রশীদ | মঙ্গলবার , ৭ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৪৩ পূর্বাহ্ণ

শবে বরাত অত্যন্ত তাৎপর্যময় রজনী। আজ ১৪ শাবান মঙ্গলবার দিবাগত রাত পবিত্র শবে বরাত। আল্লাহ তায়ালা কিছু সময়কে এমন মর্যাদাপূর্ণ করে রেখেছেনে যখন বান্দা তার বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। মধ্য শাবানের শবে বরাত এ সময়গুলোর একটি।

শব’ ফার্সি শব্দ। অর্থরজনী। ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি, নিষ্কৃতি, দায়মুক্তি, অব্যাহতি প্রভৃতি। এদিক থেকে ফারসি ভাষায় ‘শবে বরাত’ অর্থ মুক্তির রজনী। এ রাতে মনেপ্রাণে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতবন্দেগি করে স্রষ্টার কাছে নিজের গুনাহ ও অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি কবুল করেন এবং অনুতপ্ত বান্দাকে পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে মাফ করে দেন। এ কারণেই এ রাত মুক্তির রজনী। শবে বরাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বরাত’ নামেও অভিহিত করা হয়। ‘লাইলাতুন’ আরবি শব্দ। এর অর্থরাত বা রজনী। হাদিসে ‘নিসফে শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। এ রাতে আল্লাহপাক বিশ্ববাসীর তাকদীর সম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয়ের নথিপত্র কার্যকর করার জন্যে ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করেন। যার মধ্যে জন্মমৃত্যু, রিজিক, ধনদৌলত, সুখদুঃখ সবকিছুই সন্নিবেশিত থাকে। সুতরাং আজকের রাতটির গুরুত্ব ও মহাত্ম্য বিপুল। এ রাতে আল্লাহপাক মানবজাতির জন্যে নাযিল করেন প্রভুত কল্যাণ ও অসীম রহমত। এ রাত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, এ রাতে ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রেখো। কেননা, এ রাতে সন্ধ্যার পর থেকেই আল্লাহপাক প্রথম আকাশে নেমে এসে বলতে থাকেন, ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ আছো কি? যাকে আমি ক্ষমা করবো। কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী আছো কি? যাকে আমি রিজিক দেবো। কেউ বিপদগ্রস্ত আছো কি? যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করবো। এমন কি কেউ নেই? এমন কি কেউ নেই? এমনিভাবে আল্লাহপাকের মহান দরবার থেকে আহবান অব্যাহত থাকে সুবহি সাদিক পর্যন্ত। -(সুনান ইব্‌ন মাজাহ, হাদিস নং১৩৮৮)

এ মহিমান্বিত রজনী সম্পর্কে মিশকাত শরিফের অন্য হাদিসে এসেছে হে আয়িশা! তুমি কি জানো এ রাতে কি রয়েছে? হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বললেনইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি বলুন, এ রাতে কি রয়েছে। তখন রাসুল (সা.) বললেনআগামি বছর যতো আদম সন্তান জন্ম নেবে এবং যারা মারা যাবে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হবে এবং এ রাতে বিশেষভাবে বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে এবং তাদের রিজিক নাযিল করা হবে। -(মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং১৩০৫) হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) এ রাতে দেখলেন রাসুল (সা.) সিজদায় অবনত হয়ে কাঁদছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মাথা তুলে বললেনতুমি জানো এটা কোন রাত? হযরত আয়িশা (রা.) বললেননা। তখন রাসুল (সা.) বললেনএটি শাবানের মধ্যবর্তী রাত। এ রাতে যারা যতো বেশি ইবাদত করবে এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে তিনি ততো বেশি গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। যদিও গুনাহ্‌র পরিমাণ পাহাড়সম হয়।

প্রখ্যাত সাহাবি ও সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) বলেছেনশাবানের মধ্যবর্তী (১৫ শাবান) রাতে হজরত জিবরাঈল (.) আমার কাছে এসে বলেছেনহে মুহাম্মদ (সা.)! আজ আপনার মাথা আসমানের দিকে উঠান। কেননা আজকের রাত বরকতময়। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, এতে কি বরকত নিহিত রয়েছে? তখন জিবরাইল (.) জবাবে বললেনএ রাতে আল্লাহপাক তাঁর রহমতের তিনশ’ দ্বার খুলে দেন। মুশরিক, গনক, সর্বদা মদ্যপায়ী, ব্যভিচারী এবং সুদখোর ছাড়া সকলকে আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেন। -(আবু দাউদ) অবশ্য এসব অপকর্ম ত্যাগ করে খাঁটি নিয়তে তাওবা করলে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে মাফ করে দিতে পারেন।

হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাযে দাঁড়ালেন এবং এতো দীর্ঘ সময় সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়লো তারপর তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না। হে আল্লাহর রাসুল আপনার দীর্ঘ সেজদা দেখে আমার আশঙ্কা হয়েছিলো আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন। (শুআবুল ঈমান, হাদিস নং৩৫৫৪)

এ রাতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার দোয়া কবুল করার ওয়াদা দিয়েছেন; কিন্তু রাতের কোন্‌ অংশে কুবল করা হবে তা নির্দিষ্ট করে বলেনি। কাজেই আমাদের উচিৎ সারা রাত ধরে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা। মাগরিবের নামাজ, এশার নামাজ ও ফজরের নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করার পাশাপাশি এ রাতে প্রচুর পরিমাণ নফল নামাজ আদায়, জিকিরআজকার, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, দানখায়রাত করা, ফকিরমিসকিনকে খানা দান করা, আমাদের পূর্বপুরুষসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও প্রিয়জন কবরে শায়িত রয়েছেন তাঁদের জন্য কবর জিয়ারত এবং জীবনের অসংখ্য গুনাহ ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি, ইস্তিগফার, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, ওস্তাদ ও বিশ্বের সকল মুসলিমমুসলিমাত ও মু’মিনমু’মিনাতের জন্যে দোয়া করা উচিত।

এ রাতে বেশি বেশি করে কুরআন পড়ুন। কুরআন শরিফ তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেনযে ব্যক্তি কুরআনের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে ব্যক্তি এর বদলে একটি পুণ্য লাভ করবে। আর একটি পুণ্য হলো দশটি পুণ্যের সমান।-(সুনান আততিরমিজি, হাদিস নং২৯১০) রাসুল (সা.) আরও বলেছেনকুরআন তিলাওয়াত শ্রেষ্ঠ ইবাদত। হাদিসের মধ্যে আরো এসেছেরাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেনতোমরা কুরআন পড়ো। কেননা এ কুরআন কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্যে সুপারিশ করবে। -(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং৮০৪) রাসুল (সা.) অন্য হাদিসের মধ্যে ইরশাদ করেছেনযে ব্যক্তি কুরআনুল কারিম অধ্যয়ন করবে এবং তদানুযায়ী আমল করবে কিয়ামতের দিন তাঁর পিতামাতাকে এমন একটি মুকুট পরিধান করা হবে, যার জ্যোতি সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল হবে। (আবু দাউদ, হাদিস নং ১৪৫৩)

আর এ রাতে বেশি বেশি করে গুনাহ মাপের জন্যে কান্নাকাটি করুন। মানুষ শয়তানের প্রলোভনে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাপ কাজে লিপ্ত হয় এবং অন্যায় অবিচার নির্যাতন ও জুলুম করে থাকে। সমস্ত গুনাহের জন্যে লজ্জিত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। হাদিসে এসেছে, কোনো বন্দা নফসের প্রলোভনে ও শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে কোনো গুনাহর কাজ করার পর যদি আল্লাহর দরবারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনতোমরা তোমাদের রবের কাছে ইস্তিগফার করো এবং তাঁরই কাছে তাওবা করো। নিশ্চয় আমার রব পরম দয়ালু ও অতীব ভালোবাসা পোষণকারী। -(সুরা হুদ, আয়াত৯০)

এ রাতে যতো বেশি পারা যায় নফল নামাজ পড়ুন। এতে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। তবে জানা থাকলে সুরা ইয়াসিন, সুরা আররহমান, সুরা মুলুক, সুরা দুখান ইত্যাদি বড়ো বড়ো ফজিলতপূর্ণ সুরা দিয়ে পড়া ভালো। আর বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করুন। আর মাবাবা অথবা আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করুন।

আমাদের বর্তমান যুগে মুসলিমদের মাঝে ধর্মীয় মূল্যবোধ ভুলে এবং এ পুণ্যময় রাতের মাহাত্ম্য, পবিত্রতা ও গাম্ভীর্য বজায় না রেখে উৎসব পালনের নামে আতশবাজি, পটকাবাজি, অহেতুক বেশি বেশি করে আলোকসজ্জা, ইত্যাদি শরিয়ত বিরোধী কাজকর্ম করতে দেখা যায়। এ সব কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তাই আমাদের উচিত হবে এসব কর্মকাণ্ড যাতে হতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখা। এ ফজিলতময় রাতে কায়মনে বাক্যে ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় শবে বরাত পালন করলেই এর সার্থকতা হবে। আমাদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে কুরআনুল কারিমের এ আয়াত-‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ্‌য়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।’ অর্থাৎ আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং মরণ সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে।

পরিশেষে বলতে পারি শবে বরাত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করার রাত। সুতরাং আমরা যেনো এ মর্যাদাবান রাতে অহেতুক সময় নষ্ট করে গল্প গুজবে লিপ্ত না হই। যাতে এ রাতের ভাবগাম্ভীর্যতা ক্ষুণ্ন হয় এ ধরণের কাজ না করি। আল্লাহকে খুশি করার জন্যে সারা রাত ইবাদতে মগ্ন থেকে মুক্তির রজনীর ফজিলত অর্জন করি।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক, প্রফেসর, আরবি বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : মানবমুক্তির অমর ও অবিনাশী দলিল
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাইয়ে সেনাবাহিনীর অনুদান প্রদান