বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাসের মধ্যে বহু ভাষাবিদ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ অন্যতম রোমান্টিক উপন্যাস। চাকরিসূত্রে আফগানিস্তান যাওয়া বাংলাদেশের ছেলে মজনূন আর তুর্কী বংশোদ্ভূত আফগান তরুণী শবনমের প্রেমকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। পথ হারিয়ে দুজনের প্রথম দেখা, পরিচয়। প্রণয়ের এক নাতিদীর্ঘ পথ পেরিয়ে দুজনের পরিণয়। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় আবারও বিচ্ছেদ। কাছে আসা এবং হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেই প্রেমের ব্যাপ্তি। কাহিনি বিচারে আর দশটা প্রেমের উপন্যাস থেকে খুব বেশি আলাদা না হলেও ঘটনার বিস্তার, ভাষাশৈলী, কাব্যিকতা, দার্শনিকতা ও জীবনবোধের অনন্য প্রকাশই বইটিকে দিয়েছে অন্যমাত্রা। উপন্যাসজুড়ে থাকা ‘তুমি আমার ভালোবাসা কিংবা বিরহে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না’–এর মতো অসংখ্য বাক্য হয়ে উঠেছে বাঙালি নর–নারীর শ্বাশ্বত প্রেম–বিরহ প্রকাশের, অনুভবের চিরন্তন ভাষা। লেখক উপন্যাসের গল্পটি সাজিয়েছেন একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান বড়লোকের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে এক বাঙালি যুবকের প্রেমকাহিনি নিয়ে। অস্থিতিশীল আফগানের প্রেক্ষাপটে একটা নিখুঁত পবিত্র অসম প্রেমের উপন্যাস। দিনের বেলা সবকিছু স্বাভাবিক চললেও রাতের স্বপ্নময় পরিবেশে অবধারিতভাবেই শবনম তার পবিত্রতা আর হেঁয়ালি নিয়ে উপস্থিত হতো। যাকে নিয়ে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে, তার নাম মজনূন। বাংলাদেশের সিলেট থেকে আফগানিস্তানের কাবুল শহরে তিনি এসেছেন কলেজে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে। সঙ্গে থাকেন এক ভৃত্য আবদুর রহমান। মজনূন সাহেব প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যান সর্দার আওরঙ্গজেবের কন্যা শবনমের। শবনমের প্রতি মজনুনের ভালোবাসার ব্যাপ্তি দেখা যায় তার বিরহে। উপন্যাসের নায়ক মজনূনের সাথে শবনমের প্রথম দেখা হয় আফগানিস্তানের পাগমান শহরে। লেখক উত্তম পুরুষে উপন্যাসটি বর্ণনা করেছেন। শবনমের সাথে মজনূনের দেখা হওয়া, কাছে আসা, প্রেম, পরিণয়, বিচ্ছেদের মাধ্যমে কাহিনী এগিয়েছে। মজনূন শবনমের জন্য ফার্সি শিখতে শুরু করে। ফার্সি, উর্দু, ফরাসি, বাংলা কবিতায় সে শবনমকে মুখরিত করে রাখে। শবনমও কম যায় না, কবিতার ফুলঝুরিতে হারিয়ে যায়। প্রথম দেখাতে তুর্কি বংশোদ্ভূত আফগান তরুণী শবনমকে ভাল লেগে যায় বাঙালি যুবক মজনূনের। সর্দার আওরঙ্গজেব কন্যা শবনম, যে রাজকন্যা সমতুল্য তাকে কি ভিনদেশি বাঙালি শিক্ষকের পাশে মানায়? কিন্তু ভালোবাসা তো জাত–কূল মানে না! শবনমকে মজনূনের দেয়া প্রথম উপহার ছিল সিলেটি লেবু। আর শবনমের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল কাগজে লেখা কবিতা। বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন আজম শাহের আমন্ত্রণে পারস্যের কবি হাফিজের লেখা সেই কবিতা।
শবনম মজনূনের অনন্ত ভালোবাসার স্বপ্নকন্যা। সকালের সোনা রোদে শিউলি ঝরে যায়, শবনমও কি তেমনি ঝরে যাবে, এর উত্তর খুঁজতে মজনূন ব্যস্ত থাকে। কিন্তু শবনম তো কথা দিয়েছে, ‘বাড়িতে থেকো, আমি ফিরব।’ শবনমের মতো রাজস্বী, অনন্যা, স্বয়ংবরা নিশ্চয়ই তার কথা রাখবে, এ আশা কররছিলেন মজনূন ।
অনেকের মতে, সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রম্য লেখক। তবে ভ্রমণ কাহিনী, গল্প কিংবা উপন্যাসের পাতায়ও নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। সব্যসাচী এই লেখক ছিলেন বহুভাষাবিদ এবং সেই সঙ্গে বহুভাষার সাহিত্য তার করায়ত্ত ছিল। সাহিত্যিক ও শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাই মুজতবা আলীকে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তির চরিত্রধারণ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় শবনমের রূপের বর্ণনা এমন –
‘এমন সময় গটগট করে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী। প্রথম দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতোই ধবধবে সাদা। নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি নে। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত লাল টুকটুকে, তবে তাতে এমন একটা শেড রয়েছে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় এটা রুজ দিয়ে তৈরি নয়। চোখ দুটি লাল না সবুজ বুঝতে পারলুম না। পরনে উত্তম কাটের গাউন। জুতো উঁচু হিলের।’
এই উপন্যাসের মূল সৌন্দর্য অজস্র শ্রুতিমধুর কবিতায় পাঠক মুগ্ধ হবেন। মুগ্ধতার রেশে কবি হয়ে আসবেন খাজা শামসুদ্দীন মুহাম্মদ হাফিজ, শেখ সাদী, জালালুদ্দিন রুমি, কলীম কাসানি, সত্যেন দত্ত, কালিদাস প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত কবিগণ। প্রেমের অমিয় বানী কাব্যমধুর বর্ণনায় ফুল হয়ে উপন্যাসের পাতায় পাতায় সুবাস ছড়িয়ে দেবে। এ–কারণেই বোধহয় কোনো কোনো বোদ্ধা ‘শবনম’কে কাহিনীকাব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উপন্যাসটি সৈয়দ মুজতবা আলী তার স্বভাবসুলভ বেশ কিছু চমৎকার উক্তি উপস্থাপনে ভোলেননি; তার কয়েকটি তুলে দিচ্ছি–
‘আমি শ্রীকৃষ্ণ নই; জাত ধম্মো বাঁচাবার ভার আমার স্কন্ধে নয়।’ ‘জীবনই অভিজ্ঞতা, আর অভিজ্ঞতাই জীবন। অভিজ্ঞতা সমষ্টির নাম জীবন, আর জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে দেখলে এক–একটি অভিজ্ঞতা। এক–একটি অভিজ্ঞতা যেন এক এক ফোঁটা চোখের জলের রুদ্রাক্ষ। সব কটা গাঁথা হয়ে যে তসবি–মালা হয় তারই নাম জীবন।’
শবনম তার প্রেমিক মজনূনের প্রতি আবেদন জানিয়েছিল, ‘আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।’ বোধকরি সে কারণে তাদের সুখের দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার বিপরীত আকুতিও ছিল শবনমের, ‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না’। উপন্যাস পড়া শেষ করেও পাঠকের মনে হবে, শেষ হয়েও হইল না শেষ। এ আক্ষেপের উত্তরও দিয়েছে শবনম তার প্রেমিক মজনূনের কাছে,
‘গোড়া আর শেষ, এই সৃষ্টির জানা আছে, বল কার?
মুজতবা আলীর ভ্রমণ কাহিনীর ঘ্রাণ শবনমেও পাওয়া যাবে, আফগানিস্তানের কাবুল, পাগমান, মাজার–ই–শরীফ তো আছেই, সাথে আছে বাংলাদেশের সিলেট। উপন্যাসটি আত্মবর্ণনায় লেখা বলে, পাঠকের বারবার মনে হবে, সত্যিই কি মুজতবা আলীর সাথে শবনম নামের কোনো নারীর প্রণয় ছিল? সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখালেখির খাতা তেমন বড় ছিল না। এর ব্যাখ্যাটি সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় এরকম-‘হাঁড়িতে ভাত থাকলে সাঁওতাল কাজে যায় না, আর আমার ড্রয়ারে টাকা থাকলে আমি লিখি না।’ তিনি অল্পবিস্তর যা লিখেছেন, তা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে ।