১১টি লাইটারেজ জাহাজে ভাসছে প্রায় শত কোটি টাকার গম। আমদানিকৃত এসব গম তিন মাসের বেশি সময় ধরে জাহাজে রয়েছে। এতদিন জাহাজে থাকায় এগুলো নষ্ট হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। জাহাজ থেকে গমগুলো খালাসে জোর চেষ্টা চলছে। সাইলো জেটি খালি না পাওয়ায় গমভর্তি এ ১১টি লাইটারেজ গত এক মাস ধরে ভাসছে। গতকাল সকাল থেকে জেটি খালি হলেও সাইলো জেটি কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির কারণে দিনভর জেটি বন্ধ থাকে।
অভিযোগ করা হয়েছে, প্রচলিত নিয়ম না মেনে সাইলো জেটি দখল করে রাখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জেটিতে গম খালাস সম্ভব হয়নি। সাইলো কর্তৃপক্ষের অনিয়মের কবলে পড়ে জাহাজগুলোকে ইতোমধ্যে দুই কোটি টাকারও বেশি গচ্চা দিতে হয়েছে। নিয়ম শৃংখলা না মেনে সাইলো জেটিতে জাহাজ বার্থিং দেয়ার ঘটনায় সাধারণ জাহাজ মালিকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টিকে ‘একেবারে সাধারণ’ বলে মন্তব্য করে সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ শিবলী বলেন, ‘এতে পত্রিকার বা বাইরের কারো নাক গলানোর কি আছে।’
সূত্র জানিয়েছে, সরকারের আমদানিকৃত রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বিপুল পরিমাণ গম চট্টগ্রামে খালাস করা হয়। এরমধ্যে জাহাজের ড্রাফট কমানোর জন্য ১১টি লাইটারেজ জাহাজে বিশ হাজার আটশ’ টনের মতো গম লাইটারিং করা হয়। মাদার ভ্যাসেল দুইটি গম খালাস করে চলে যাওয়ার পর উক্ত ১১টি লাইটারেজ জাহাজকে সিরিয়ালি সাইলো জেটিতে বার্থিং দিয়ে গম খালাস করার কথা।
প্রায় এক মাস আগে গত ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর তারিখের মধ্যে খালাসকৃত গমগুলো নিয়ে লাইটারেজ জাহাজগুলো সাইলো জেটির সিরিয়ালের অপেক্ষা করছিল। প্রতিদিন একটি করে জাহাজের পণ্য খালাস করলেও এসব জাহাজের পণ্য খালাস করতে ১০/১১ দিন সময় লাগবে। প্রায় এক মাসের মতো জাহাজের হ্যাচে থাকা গমগুলোর মান নষ্ট হতে শুরু করেছে।
কোনও কোনও জাহাজের গমে পোকা ধরেছে। গমগুলোর মধ্যে নয়টি লাইটারেজ জাহাজে বোঝাইকৃত বিপুল পরিমাণ গম গত সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেন থেকে এমভি ম্যাগনাম ফরচুন নামের মাদার ভ্যাসেলে বোঝাই করা হয়েছিল। এতে করে মাদার ভ্যাসেল এবং লাইটারেজ ভ্যাসেল মিলে গত তিন মাসেরও বেশি সময় জাহাজে থাকা গমগুলোর অবস্থা বেশ নাজুক। এগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। জাহাজের নাবিকদের উদ্বৃতি দিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ইতোমধ্যে কোনও কোনও জাহাজের গমে পোকা চলে আসার কথা নিশ্চিত করেছে।
অপরদিকে এসব জাহাজের প্রতিটির পেছনে প্রতিদিনই বিপুল অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় জাহাজগুলো থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গম খালাসে সব ধরনের চেষ্টা করা হয়। যত দ্রুত এসব গম খালাস করা যাবে ততই সবার জন্য মঙ্গল বলে মন্তব্য করে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এতে শুধু ব্যক্তিগত লাইটারেজ জাহাজই নয়, সরকারের একশ’ কোটি টাকার গম রক্ষার বিষয়টিও জড়িত। তিনি বলেন, তিন মাস আগে এসব গম জাহাজে বোঝাই করা হয়। সরকার প্রতিটন গম ৪৩০ ডলার করে কিনেছে।
গতকাল সকালে সাইলো জেটি থেকে পণ্য খালাস করে মাদার ভ্যাসেল নোঙর তোলে। সাইলো জেটি খালি হওয়ার সাথে সাথে অপেক্ষমাণ ১১টি লাইটারেজ জাহাজ থেকে সিরিয়ালি পণ্য খালাস শুরু হওয়ার কথা। এজন্য সাইলো কর্তৃপক্ষের নিকট বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানাধীন এগারটি লাইটারেজ জাহাজের তালিকা প্রদান করা হয়েছে। তালিকানুযায়ী শুরুতে এমভি ম্যাগনাম ফরচুন মাদার ভ্যাসেল থেকে ১৯৮০ টন গম নেয়া এমভি লামিয়া নামের লাইটারেজ জাহাজের পণ্য খালাসের কথা। এই জাহাজটিতে গত ১৪ নভেম্বর গম বোঝাই করা হয়।
কিন্তু রহস্যজনক কারণে সিরিয়াল না মেনে তালিকায় ৬ এবং ১১ নম্বর সিরিয়ালে থাকা লাইটারেজ যথাক্রমে এমভি আবু নঈম–৬ এবং এমভি মধু কাজী জাহাজকে বার্থিং দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাইলো কর্তৃপক্ষ বিশেষ সুবিধা নেয়ার পর সিরিয়াল ভঙ্গ করে উপরোক্ত দুইটি জাহাজকে জেটিতে বার্থিং দিয়েছে। বিষয়টি জানাজানির পর অপরাপর জাহাজ মালিক, শিপিং এজেন্ট, ডব্লিউটিসিসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের মহা–পরিচালক থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তোলপাড় শুরু হলে সাইলো কর্তৃপক্ষ বার্থিং দেয়া জাহাজ দুইটি থেকে পণ্য খালাস শুরু করতে পারেনি। অপরদিকে জাহাজ দুইটিও জেটি না ছেড়ে দখল করে বসে থাকে।
ফলে সিরিয়ালের অন্য জাহাজও ভিতরে যেতে পারেনি। গুরুত্বপূর্ণ জেটিটিতে সারাদিন কোনও পণ্য খালাস হয়নি। গতরাত নয়টা নাগাদ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুইটি লাইটারেজ জেটির আনলোডিং পয়েন্ট দখল করে বসে আছে। ইতোপূর্বেও মাদার ভ্যাসেল বার্থিং নিয়ে সাইলো কর্তৃপক্ষের অনিয়মের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। নিজেদের মতো করে জাহাজ বার্থিং দেয়ার অভিযোগ রয়েছে খাদ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এই জেটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অথচ গতকাল দিনভর কাজ করলে একটি লাইটারেজ জাহাজের গম খালাস করা সম্ভব হতো। জেটি অচল থাকায় সংশ্লিষ্ট সকলেই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষতি হয়েছে সরকারেরও।
বিষয়টি নিয়ে গতরাতে সাইলো সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ উল্ল্যাহ শিবলীর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, ‘কী এমন হয়েছে যে পত্রিকাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ দিনভর জেটির কার্যক্রম বন্ধ থাকাকে ‘অতি সাধারণ একটি ব্যাপার’ বলে দাবি করে তিনি বলেন, এজন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?
বিষয়টি নিয়ে লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সাইলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি জেটি।
খাদ্যশষ্য খালাস এবং পরিবহনের সাথে জড়িত এই জেটির প্রতিটি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কর্তৃপক্ষের একগুয়েমির জন্য দিনভর জেটি অচল করে রাখা দুঃখজনক। জাহাজগুলো অলস বসে আছে প্রায় এক মাস ধরে। গমের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমন কঠিন একটি সময়ে এমন উদাসীনতা রহস্যজনক। তারা বিষয়টির তদন্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।