চন্দনপুরা মসজিদ শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়। এটি বিশ্ব–ঐতিহ্যের একটি স্মারক, একটি নিদর্শনও বটে। নবাব সিরাজদ্দৌলা রোডের চন্দনপুরা এলাকায় এ দৃষ্টিনন্দন ও চমৎকার শৈল্পিক বৈশিষ্ট সম্বলিত মসজিদটি সকলকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বহু দেশী–বিদেশী পর্যটক এ–মসজিদ দেখতে নিয়মিত ভিড় জমায়। ছোটবেলা থেকে নবাব সিরাজদ্দৌলা রোড এলাকায় বড়ো হয়েছি। আবার চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র হিসেবে যাওয়া আসার পথে প্রতিনিয়ত মসজিদটির দর্শনের সুযোগ হতো। এসব কারণে আমি মসজিদটির প্রতি হৃদয়ের আলাদা একটা টান অনুভব করি। মসজিদের সামনে মাজার গলির মুখেই আমার ছোটো বোন এডভোকেট জান্নাতুন নাঈম রুমানার শ্বশুর বাড়ি। মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বে আরেক বোন কানিজ ফাতেমা মুন্নির স্বামীগৃহ। ফলে প্রায়ই এ মসজিদে নামাজের সুযোগ হয়। এ মসজিদের ঈমাম–মুয়াজ্জিনগণও অনেক কামেল ও পরহেজগার ছিলেন। এ মসজিদের বর্তমান ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করছেন হেলাল উদ্দিন। আর বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সাথে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন মুহাম্মদ জাকারিয়া। এ মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতীবদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন বিশিষ্ট আলেম মরহুম মওলানা মোখতার হোসাইন সাহেব (মৃত্যু ২০০৮ ইংরেজি) চরম বার্ধক্যের আগ পর্যন্ত এ প্রবীণ আলেম তুমুল জনপ্রিয়তার সাথে কয়েক যুগ ধরে নিষ্ঠা ও সততায় এ ঐতিহাসিক মসজিদের ইমাম ও খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। পূর্বে বিভিন্ন সময়ে মসজিদের মুয়াজ্জিন/ভারপ্রাপ্ত মুয়াজ্জিন ও খাদেমের দায়িত্ব পালন করেন মুহাম্মদ আলী, ইদ্রিস ও প্রমুখ বিশিষ্ট খাদেমে দ্বীনগণ। চন্দনপুরা মসজিদ শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয় এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি স্মারক । নবাব সিরাজদ্দৌলা রোডের চন্দনপুরা এলাকায় এ–দৃষ্টিনন্দন ও চমৎকার শৈল্পিক বৈশিষ্ট সম্বলিত মসজিদটি সকলকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমি সিডিএ এর প্যানেল লইয়ার থাকাকালে নবাব সিরাজদ্দৌলা রোড সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন, তদানিন্তন সিডিএ চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার শাহ মোহাম্মদ আখতার ভাই, তিনি এই ঐতিহাসিক মসজিদটি রক্ষার জন্য পূর্ব দিকে ফায়ার ব্রিগেডের জমি বেশি অধিগ্রহণের নির্দেশ দেন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজ–উদ–দৌলা সড়কে শায়েস্তা খাঁর স্মৃতিবাহী চন্দনপুরা বড় মসজিদ। অনেকের কাছে এ মসজিদটি চন্দনপুরা বড় মসজিদ বা তাজ মসজিদ নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করলে এখানে মোঘল শাসন কায়েম হয়। তখন শাহি ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে মোঘল স্থাপত্য শিল্পের ছোয়ায় ছোট বড় অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সে সময়কার হামজা খানের মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম। যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলায় মোঘল শাসনামলে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে এ মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ শুরু করেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ। মসজিদে ঢুকতে কার্নিশে খোদাই করে লিখা আছে নামটি। ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেয়াল আর টিনের ছাদ দিয়ে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বংশধর বৃটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের সংস্কার কাজে হাতে দেন। এতে সেই সময়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকারও অধিক খরচ হয়। ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের দিকে মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয়। আর সে সময় সংস্কার কাজের জন্য লক্ষ্ণৌ থেকে আনা হয় মোগল ঘরানার কারিগর। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য নানা উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাহারি রঙে সাজানো অনন্য ডিজাইনের মসজিদটি এখনও ধারণ করে আছে মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও গাম্ভীর্য। মসজিদের ওজুখানা, সিঁড়ির হাতল, কার্নিশ, দেয়ালসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে অত্যন্ত নিখুঁত কারুকার্য। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পুরোনো এইসব ডিজাইনগুলোই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে নানান রঙের বর্ণাচ্ছটায়। মসজিদটির নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ১৫টি গম্বুজ। জনশ্রুতি আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গম্বুজ নির্মাণে ব্যবহার করা হয় প্রায় ১০ টন পিতল। এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ প্রকাণ্ড গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। তবে এখন সেই নান্দনিকতা নেই। প্রতিটি গম্বুজে যাওয়ার জন্য আছে সিঁড়ি। গম্বুজ ও সিঁড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোগল স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতিচ্ছবি। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদের গম্বুজের চারপাশে লেখা আছে রাসুল (সাঃ)-এর পরিবার ও দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম। মসজিদের সুউচ্চ মিনার, দেয়াল, দরজা–জানালা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সূক্ষ্ম কারুকাজ। মসজিদের চারদিকে আছে হরেক রঙের ব্যবহার। মসজিদটির প্রতিটি অংশে সবুজ, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপীসহ হরেক রঙ ব্যবহার; লতা–পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে। অতীতে মাটির দেয়ালে কারুকাজ ছিল। চট্টগ্রামের আইকনিক ছবি হিসেবে এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকাশনায়। স্থাপত্য শিল্পে তাক লাগানো এই মসজিদের আয়তন তিন গণ্ডার মতো। এছাড়া মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। যখন মাইকের ব্যবহার ছিল না তখন মসজিদটির চার তলা সমান উঁচু মিনারে উঠে আজান দেয়া হতো। বর্তমানে মাইকে আজান হলেও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ মিনার ও আজানখানা। রাজপথে চলাচলকারী পথিকেরও একনজর দেখে নেওয়ার সুযোগ হয় কালের সাক্ষী এ মসজিদটি। এছাড়া জাপানের এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রায় ১৫৪ বছরের বেশি আগে নির্মিত ঐতিহাসিক চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ’ অপরিকল্পিত সংস্কারকাজের ফলে স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। মসজিদের মোতাওয়াল্লি সূত্রে জানা যায়, সূক্ষ্ম কাজের কারিগরের অভাবে সংস্কার কাজও সঠিকভাবে করা যায় না। বৈরি আবহাওয়ায় এসব জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। সাধারণত দিনে গড়ে কয়েক শত লোক নামাজ পড়েন এই মসজিদে। শুক্রবার জুমআর দিনে মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। বর্তমানে মসজিদে ১ জন ইমাম, ১ জন হাফেজ ও ২ জন মুয়াজ্জিন রয়েছেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের খেদমত করছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এ মসজিদ দেখতে আসেন। আশপাশেও অনেক নতুন মসজিদ গড়ে উঠেছে। এরপরও এ মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণত দিনে গড়ে ৮ থেকে ৯শ’ লোক নামাজ পড়েন এ মসজিদে। শুক্রবারে হাজার তিনেক ছাড়িয়ে যায়। তখন মসজিদে জায়গা সংকুলন না হলে রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এখন প্রতি ৫ বছর পর একবার রঙ করা হয়। একবার রঙ করার কাজ শেষ করতে প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস সময় লাগে। আশা করা যায় যথাযথ পরিচর্যা হলে আরও দীর্ঘদিন কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের এই সুন্দর মসজিদটি ।
লেখক : আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, কলামিস্ট ও সুশাসন কর্মী।