আফগানিস্তান এখন তালিবান জংগিদের দখলে। আমেরিকার সেনাবাহিনী আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণকে দুই কুখ্যাত জংগি গ্রুপ তালিবান ও আইএসআইএসকে-এর মধ্যকার খুনোখুনির যুপকাষ্ঠে নিক্ষেপ করে নীরবে আফগান ত্যাগ করেছে। আফগান জনগণ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন পরাশক্তির হাতে তাদের ভাগ্যের নাটাই শুধুই হাত বদল হতে দেখেছে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগান জনগোষ্ঠীর এক বিশাল অংশ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে আফগানিস্তান কবিতার দেশ হিসেবে পরিচিত। জালালুদ্দিন রুমি, মহাকবি ফেরদৌসী, রাবিয়া বলখী’র মতো জগৎবিখ্যাত সব কবিদের জন্মভূমি এই আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে সুসমৃদ্ধ কাব্যিকধারা। আফগানিস্তানের বর্তমান সময়ের কবিরা বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর জীবনযাপন করছেন। তাদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত ইলিয়াস আলাভী, ইংল্যান্ডে নির্বাসিত শুকরিয়া রিজাঈ, বাদাখশানের পার্থ নাদেরি বেশ আলোচিত ও পঠিত। এখানে ইলিয়াস আলাভী ও শুকরিয়া রিজাঈ এর একটি করে এবং পার্থ নাদেরির দুটো কবিতার ভাষান্তর পাঠকের জন্য তুলে দেয়া হলো। এই ক্ষুদ্র ভাষান্তর সম্প্রতি তালেবানের হাতে নিহত আফগান কবি ও ইতিহাসবিদ আব্দুল্লাহ আতেফির স্মরণে উৎসর্গ করা হলো। কবিতার শিরোনাম ইংরেজিটাই বহাল রাখা হলো পাঠকের মূল কবিতা খুঁজে নেয়ার সুবিধার্তে।

Where is the Homeland?
ইলিয়াস আলাভী
স্বদেশ, একটি কাঠের টেবিল
যার চারপাশে বসে
আমরা চা পান ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম
অভিবাসন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তেও।
স্বদেশ
একটি পুরানো নৌকা
এজিয়ান সাগরের বুনো ঢেউয়ের মাঝে দিশাহীন
‘দোহায় আল্লাহর, সাগর শান্ত হয়ে যাও
শান্ত হয়ে যাও দুরন্ত মেঘ
শান্ত হয়ে যাও ঝঞ্ঝা বাতাস!’
বৃদ্ধ কাপ্তান প্রার্থনা করছিল
বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মধ্যে তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও।
স্বদেশ
সিমেন্টের উঁচু দেয়াল আর কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা
তোরবাত-ই-জাম এর এক বন্দি শিবির
লম্বা লাইন
রুটি, পত্র, ও লজ্জার।
স্বদেশ
লন্ডনের এক দূরবর্তী ক্যাফে
যেখানে কুয়াশা, ধোঁয়া, আর অন্ধকারের মাঝে
ভাঙাচোরা ছায়ার, নিঃষ্প্রাণ, নিরুদ্দেশ চোখের মানুষেরা
বেদনার্ত, তিক্ত নিঃশ্বাসের সাথে
শেষ করে তাদের দুর্দশার পেয়ালা।
তাল্-ই-সিয়াহ
কোয়েটা
ইস্তাম্বুল
নাঊরু
ওমেরা
স্বদেশ সম্ভবত আল-খলিল গোরস্থানে একটি ছোট্ট কবর
যে খুব ক্ষুধার্তভাবে অপেক্ষা করছে আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের।
স্বদেশ কোথায়?

My Hazara People
শুকরিয়া রিজাঈ
আমি আমার হাজারা জাতির কথা লিখতে পারব না
যারা তাদের বাদাম-আকৃতির চোখের কারণে
দশকের পর দশক সয়ে আসছে চরম দুর্ভোগ
তাদের জন্মস্থান আফগানিস্তানে
তারা হত্যার শিকার হয়েছে পাকিস্তানে
তারা লাঞ্ছিত হয়েছে ইরানে
আমার হৃদয় আজ শূন্য!
আমি লিখতে পারব না কী গগনবিদারি ছিল গুলির আওয়াজ
আমার বাড়ি থেকে মাত্র দুমাইল দূরে,
বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন আমার চাচী
আর হত-বিহ্বল আমার মায়ের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল পেয়ালা
আমি লিখতে পারব না হত্যার শিকার কত নিঃষ্পাপ মানুষ
কীভাবে শহিদদের লাশে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছিল গোরস্থান
কত যন্ত্রণাই না সহ্য করেছে আমার জাতি
কতোই না নিষ্ঠুর
কতোই না ভীতিপ্রদ এই পৃথিবী
আমার মতো শিশুদের জন্য।

Journey to Kandahar
পার্থ নাদেরি
আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেছিলাম
এবং দ্রুতই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
আর কখনোই দেখা হবে না জেনেও, বলে উঠলাম:
‘আশা করি শীঘ্রই দেখা হবে’
মা হাসলেন:
‘নিশ্চয়, এটা তো আর অগস্ত্যযাত্রা নয়?’
আর আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম, নিঃষ্প্রাণ, তিক্ত হাসি।
তারপর
ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল, করুণভাবে
হাজারো আকুল যাত্রী হাত নাড়ল ঐদিক থেকে
হাজারো ব্যাকুল আত্মীয় বিদায় জানাল এদিক থেকে।
আমরা বাড়ি চলে গেলাম
এবং অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নির্বাসন নিলাম
মা
বারান্দায় গিয়ে বাগানের ফুলগুলোর দিকে একটু দেখেই
দুহাত ছড়িয়ে ফুঁঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
The Bloody Epitaph
পার্থ নাদেরি
এই পাম গাছের বসন্তের কোন আশা নেই
এই পাম গাছে ফোটে হাজারো বেদনার ক্ষত
– প্রতিদিনই হাজারো বিয়োগের ক্ষত
– প্রতিরাতই হাজারো বিপর্যয়ের ক্ষত
এই পাম গাছ শতাব্দীর চৌরাস্তায় এক রক্তাক্ত এপিটাফ
****
এখানে, নদীর পাশে
রক্ত ও কান্নার নদী-
এই পাম গাছের শেকড় জমাট বেঁধেছে দুর্যোগের সাথে
আর গাঁটছাড়া বেঁধেছে সময়ের অন্ধ উৎসের সাথে
****
এখানে, আকাশ
রক্তিম নিঃস্ফলা মেঘ থেকে খুলে দেয়
রক্তাক্ত কাফনের কাপড় মুড়ে দিতে ভাঙা কফিনের ডালা
– যেন বা বৃষ্টির ভেঙে যাওয়া আয়না-
এই পাম গাছের বসন্তের কোন আশা নেই
****
এই পাম গাছের বসন্তের কোন আশা নেই
এই পাম গাছ ক্ষত-বিক্ষত
উত্তরী বায়ুর চাবুকের শত আঘাতে
আমার পাম!
আমার একমাত্র গাছ!
আমার বসন্ত!
অনেক বছর হয়ে গেছে
তোমার শুকনা ডাল হতে চলে গেছে ফুলের পাখিরা
প্রজাপতিরা তোমাকে করেছে পরিত্যক্ত
আর ভেঙে গেছে আমার হৃদয়।












