শতাধিক জনবল চায় চমেক হাসপাতাল

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সংস্কার পরবর্তী আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। জরুরি বিভাগের স্থলে নাম রাখা হয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার (ওসেক)। শুধু নাম নয়, পাল্টে গেছে সেবার ধরনও। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আদলেই এখানে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন রোগীরা। গত বছরের (২০২১ সালের) ৪ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে এই ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের সেবা চালু হয়েছে। তবে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আদলে সেবাদানের এই উদ্যোগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জনবল সংকট। এতে করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে চাইলেও প্রত্যাশিত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এখানে। এই সংকট কাটাতে উদ্বোধনের কয়েক মাসের মাথায় প্রয়োজনীয় পদ সৃজন ও জনবল চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দেয় হাসপাতাল প্রশাসন। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর চমেক হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীরের স্বাক্ষরে এ চিঠি পাঠানো হয়। এর প্রেক্ষিতে চমেক হাসপাতালের ওসেক-এর জন্য নতুন পদ সৃজনের প্রস্তাবনা সমপ্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ১৬ মার্চ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলামের স্বাক্ষরে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর এ প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত চিঠির একটি অনুলিপি দেয়া হয়েছে চমেক হাসপাতালকে। হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান এ সংক্রান্ত অনুলিপি পাওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। হাসপাতাল পরিচালক আজাদীকে বলেন, পদ সৃজনে আমাদের প্রস্তাব সম্বলিত চিঠির প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। বলতে পারি, এটা আমাদের জন্য একটা অগ্রগতি। চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে ১০৮টি পদ সৃজনে আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল। এখন মন্ত্রণালয়ে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো। প্রস্তাব অনুযায়ী পদ সৃজনের মাধ্যমে জনবল দেয়া হলে ওসেক-এর সেবা আরো উন্নত করা সম্ভব হবে। সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত সেবাটাও আমরা দিতে পারবো।
চমেক হাসপাতাল কর্তৃক পাঠানো প্রস্তাবনায় দেখা যায়, ওসেক-এর জন্য মেডিসিন, সার্জারি, অর্থো সার্জারি, এ্যানেসথেসিয়া, কার্ডিওলজি ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের কনসালটেন্ট, সিনিয়র কনসালটেন্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট এবং মেডিকেল অফিসারসহ বিভিন্ন পদ সৃজনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকের বাইরে রেডিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, সিকিউরিটি অফিসার, ফার্মাসিস্ট, স্টোর অফিসার, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, কাউন্সিলর, পরিসংখ্যানবিদ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীর পদ সৃজনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়। চিকিৎসক-স্বাস্থ্য কর্মী ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে মোট ১০৮টি পদ সৃজনের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবনায়। চমেক হাসপাতালের এই প্রস্তাবনা অপরিবর্তিত রেখে তা মন্ত্রণালয়ে অগ্রায়িত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, ৮০ শয্যার ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে জরুরি রোগ নির্ণয়ে যুক্ত করা হয়েছে বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম। এর মধ্যে আলট্রাসনোগ্রাম, ইকো কার্ডিয়াগ্রাম, পোর্টেবল এক্স-রে, ইসিজি ও এনালাইজারসহ অন্যান্য বেশ কয়টি সরঞ্জাম রয়েছে। এখন জরুরি বিভাগেই এ সব পরীক্ষার সুবিধা পাচ্ছেন রোগীরা। এ সব পরীক্ষার জন্য আগের মতো ওয়ার্ডে-প্যাথলজিতে ঘুরতে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবায় মেডিসিন, সার্জারি, কার্ডিওলজি, অর্থোপেডিক এবং অ্যানেসথেসিয়াসহ প্রয়োজনীয় সব বিভাগের একজন করে কনসালটেন্ট সার্বক্ষণিক (শিফট ভিত্তিতে) নিয়োজিত থাকার কথা এখানে। চিকিৎসকদের জন্য আলাদা কক্ষও প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া দুটি অপারেশন থিয়েটার (ওটি), ৬টি হাই ডিপেন্ডেড ইউনিট (এইচডিইউ) ও পর্যায়ক্রমে ৪টি আইসিইউ শয্যা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে।
ওসেক-এর সেবা চালুর প্রাক্কালে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, একজন রোগী আসা মাত্রই এখানে রাখা হবে। চিকিৎসক পর্যবেক্ষণ করবেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হলে সেটাও এখানে করা হবে। রোগীদের ২৪ ঘণ্টার মতো এখানে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। এর মধ্যে যেসব রোগীর আর চিকিৎসার প্রয়োজন হবে না বা বাসায় চিকিৎসা নিতে পারবেন, তাদের বিদায় করে দেয়া হবে। যেসব রোগীর আরো দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা প্রয়োজন, শুধু সেসব রোগীকেই আন্তঃবিভাগে ভর্তি দেয়া হবে। মোটকথা, একজন রোগী জরুরি বিভাগে আসার পর জরুরি সব ধরণের চিকিৎসা যাতে এখানেই (ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারে) পান, সে আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীর।
এর আগে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংস্কারে একগুচ্ছ পরিকল্পনা তৈরি করে তা প্রস্তাবনা আকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনার কথা বলা হয় প্রস্তাবনায়। আর এই সংস্কার কাজ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগটিকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনতে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় এ অর্থ বরাদ্দের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। পৃথক তিনটি পেইজে এ সংস্কার কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-১। এর মধ্যে একটি পেইজে ২ কোটি টাকা এবং অপর দুটি পেইজে ২ কোটি টাকা (প্রতিটিতে ১ কোটি) বরাদ্দ দেয়া হয়। মূলত এর পরপরই জরুরি বিভাগের সংস্কার কাজ শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, একটি হাসপাতালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধরা হয় জরুরি (ইমার্জেন্সি) বিভাগকে। সংকটাপন্ন রোগীকে জরুরি চিকিৎসার আশায় প্রথমে নিয়ে আসা হয় এই জরুরি বিভাগেই। কিন্তু জরুরি চিকিৎসার কোনো সরঞ্জামই ছিল না চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে! শুধু সরঞ্জামই নয়, বিভাগটিতে ছিল না একজন কনসালটেন্টও! প্রতি শিফটে মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার পদের চিকিৎসক দিয়েই চলছিল জরুরি বিভাগের এ সেবা। ১৯৬০ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবেই চলে আসছিল। যদিও মাঝে-মাঝে এক শিফটে দুজন মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করেন বলে দাবি জরুরি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ১১ আগষ্ট ‘জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জামই নেই জরুরি বিভাগে’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
জরুরি বিভাগ সংশ্লিষ্টদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, জরুরি বিভাগে একজন রোগী আসার পর যত দ্রুত সম্ভব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে রোগীটিকে পাঠানোর কাজটি করে থাকেন তাঁরা। এ ছাড়া গুরুতর নয়, এমন রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। আর দুর্ঘটনায় আহতদের প্রাথমিকভাবে ড্রেসিং সেবা দেয়া হয়ে থাকে। বছরের পর বছর ধরে মূলত এ রকম দায়িত্বই পালন করে আসছিলেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা।
অথচ একজন সংকটাপন্ন রোগীর জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদানের যাবতীয় আয়োজন জরুরি বিভাগে থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্টরা বলেন, জরুরি বিভাগে কনসালটেন্ট (বিশেষজ্ঞ) থাকাটাও অপরিহার্য। অন্তত কার্ডিওলজি, সার্জারি (অর্থোপেডিক), মেডিসিন ও অ্যানেসথেশিয়ার একজন করে কনসালটেন্ট থাকাটা জরুরি। এছাড়া অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও ড্রেসিং রুমের পাশাপাশি রোগ নির্ণয়ের জরুরি কিছু সরঞ্জাম (এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাফি, ইসিজি, ইকো কার্ডিয়াগ্রাম) থাকা প্রয়োজন।
এর বাইরে সংকটাপন্ন রোগীর জন্য আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) অথবা এইচডিও (হাই ডিপেন্ডেড ইউনিট) থাকলে সেটিকে একটি আদর্শ জরুরি বিভাগ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এর কিছুই ছিল না। ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট দৈনিক আজাদীর ওই প্রতিবেদন (‘জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জামই নেই জরুরি বিভাগে’ শিরোনামে) প্রকাশের পরই জরুরি বিভাগটি সংস্কারে পরিকল্পনা গ্রহণ করে চমেক হাসপাতাল প্রশাসন। সংস্কারের মাধ্যমে জরুরি বিভাগকে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের আওতায় আনা, সার্বক্ষণিক কনসালটেন্ট রাখা, এইচডিও, ওটি, এক্স-রেসহ জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম রাখার কথা বলা হয় পরিকল্পনায়। একগুচ্ছ পরিকল্পনা সম্বলিত প্রস্তাবনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ ‘পাল্টে যাচ্ছে জরুরি বিভাগ/একগুচ্ছ পরিকল্পনা’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সংস্কার পরবর্তী অবশেষে ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
হাসপাতাল প্রশাসনের তথ্য মতে, জরুরি বিভাগের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। আর দৈনিক প্রায় ২০০ রোগী জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে তাঁরা বাসায় ফিরে যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রথমবার মানব জিনের পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস জানল মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত দুই