শতাধিক চরে মৃতপ্রায় মাতামুহুরী

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:০০ পূর্বাহ্ণ

পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীটির অতীতে প্রমত্তা তকমা থাকলেও সেটি এখন মৃতপ্রায়। নদীর অনেক স্থান দিয়ে এক সময় ঘাটপারের (নৌকাযোগে পারাপার) ব্যবস্থা থাকলেও সেটিও এক প্রকার বিলুপ্তই হয়ে গেছে। বর্তমানে নদীর অন্তত শতাধিক স্থানে চর জেগে ওঠায় তার মধ্য দিয়ে হেঁটে এপার থেকে ওপারে অনায়াসে যাতায়াত করছেন দুই তীরের লোকজন।
এ অবস্থায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হলে ভারি বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নদীর দুই তীর উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। এতে চকরিয়া ও পেকুয়ায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন এখানকার মানুষ। একইসাথে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয় নদীর দুই তীরে। এভাবে ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙনের কবলে পড়ে গত দুই যুগে ভিটে-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছেন অন্তত ১০ হাজার পরিবার। এদের অনেকে সরকারি খাস জায়গা, বনভূমি এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঠিকানায় উঠে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিচ্ছে। এ নিয়ে গত এক যুগ ধরে এখানকার ভুক্তভোগীরা সরকারের কাছে নদীকে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং (খনন) করে এবং দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের দাবি করে আসলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
অবশ্য ২০১৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাইলট প্রকল্প হিসেবে নদীর চকরিয়া অংশের মাত্র তিন কিলোমিটারে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করে। প্রকল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ে নাব্যতা সংকট কাটিয়ে উঠতে দুই কোটি টাকা ব্যয় করে। নয়-ছয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া সেই কাজে আদতে কোনো ফলাফল আসেনি। এতে একদিকে অনেকগুলো সরকারি টাকার শ্রাদ্ধ হল, অন্যদিকে রয়ে গেল চকরিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের দুঃখ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের খরস্রোতা প্রমত্তা মাতামুহুরী নদী কয়েক দশকের ব্যবধানে বর্তমানে চরম নাব্যতা সংকটে পড়েছে। নদীর উৎপত্তিস্থল পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও আলীকদম উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে গত কয়েক দশকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাথর আহরণের কারণে প্রতিবছর বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলি জমে বছরের পর বছর ১৬৫ কিলোমিটার আয়তনের মাতামুহুরী নদীর বেশির ভাগ স্থানে শতাধিক ডুবোচর জেগে উঠেছে। এই অবস্থার কারণে নদীর একাধিক পয়েন্টে পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে ভয়াবহ নাব্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এই নদী। শুধু তাই নয়, এভাবে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিক পানি চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে করে নতুন নতুন এলাকায় নদীর দুই তীরে ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, প্রতি বছর মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি আটকিয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা এবং বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক সেচ সুবিধা নিয়ে বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করে আসছে। তদ্মধ্যে চকরিয়া ও পেকুয়ার অন্তত ৭০ হাজার একর জমিতে আমন, বোরো ও রবি শস্যের চাষাবাদ করেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকতা এস এম নাসিম হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, মাতামুহুরী নদীর সেচ সুবিধা নিয়েই কৃষকরা চাষের মাধ্যমে ইতিমধ্যে আত্মনির্ভরশীল হয়ে
উঠেছেন। এখানে উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্থানীয় ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে নদীতে একাধিক স্থানে বালুচর জেগে ওঠায় কিছু কিছু এলাকায় সেচ সুবিধা নিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী শাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকরা আগের মতো মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানির সুফল পাবে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাঈফ আহমেদ বলেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধ করতে দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর দুই তীর সংরক্ষণে জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার। অর্থ মিললেই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হতে পারে।
মাতামুহুরী নদীর দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত ড্রেজিং (খনন) বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করা হবে। ইতোমধ্যে দেশীয় সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এর মাধ্যমে নদীর তলদেশ খননের সম্ভাব্যতা যাচাই তথা পিজিবিলিটি স্টাডিও সম্পন্ন করা হয়েছে। দেশীয় সংস্থাটি ইতোমধ্যে প্রকল্প প্রস্তাবনাও তুলে ধরেছে। এটি নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে বিস্তারিত আলোচনাও হয়েছে। এর পর সেই প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে খনন করে দুই নদীর গভীরতা ফিরিয়ে এনে গতিপথ ঠিক রাখার জন্য এই মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলেই মাতামুহুরী নদী আশীর্বাদে পরিণত হবে।
কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, মাতামুহুরী নদীকে যথাযথভাবে শাসন ও দুই তীর সংরক্ষণ করা গেলে অতীতের মতো প্রতিবছর বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে এখানকার মানুষ। সেই কাজ বাস্তবায়নের জন্য জোরালো তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতৃতীয় দিনে লিডের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬