সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ চাকরিকাল শেষ করার পর মাসিক পেনশন প্রাপ্তির বিধান। এই পেনশন শতভাগ সমর্পণ করার বিধানও ছিল। কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ ইচ্ছা করলে তাদের চাকরিকাল শেষ করে অবসরে যাবার প্রাক্কালে অবসরকালীন মাসিক প্রাপ্তব্য পেনশন শতভাগ সমর্পণ করে এককালীন অর্থ উত্তোলন করতে পারতেন। অত্র বিধান অনুযায়ী অবসরে যাবার পূর্ব মুহূর্তে প্রাপ্তব্য মাসিক মূল বেতনের ৮০% শতাংশ হিসাব করে মোট একশত মাসের (আট বছর চার মাস) বেতন এককালীন উত্তোলন পূর্বক শতভাগ পেনশন সমর্পণ করা হতো। একত্রে উত্তোলিত উক্ত অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলে ১২% শতাংশ থেকে ১৮% শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ উত্তোলন করা যেত। তখন দেশে মুদ্রাস্ফীতির ব্যাপকতা সহনীয় পর্যায়ভুক্ত ছিল এবং দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালে থাকায় ব্যাংকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ দ্বারা দৈনন্দিন খরচ করতে কোন সমস্যা ছিল না। তখন “ইএফটি” এর মাধ্যমে ব্যাংক একাউন্টে মাসিক পেনশন আসার নিয়ম ছিল না। অতএব, বৃদ্ধ বয়সে প্রতিমাসে পেনশন উত্তোলনের জন্য হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে ধর্না দিয়ে সমগ্র দিনের ভোগান্তি, তৎপরবর্তী টাকা উত্তোলনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে দৌড়াদৌড়ির ঝামেলা এড়াতে এককালীন প্রাপ্ত অর্থ উত্তোলন করে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করে দিতেন।
পর্যায়ক্রমে চলমান ধারায় জাতীয় বেতন স্কেল-১৯৯৭ এবং জাতীয় বেতন স্কেল-২০০৫ খৃষ্টাব্দ অনুযায়ী বেতন প্রাপ্তি অবস্থায় যে সকল সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী অবসরে গিয়েছিলেন, তাদের প্রাপ্ত অর্থ তথা একত্রে উত্তোলিত টাকার পরিমাণ ছিল বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত নগন্য। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রচলিত নিয়মে ২০০৯ এবং ২০১৫ খৃষ্টাব্দে সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতন-স্কেল বৃদ্ধিকরণ ছিল নি:সন্দেহে একটি জনকল্যাণমুখী যুগান্তকারী পদক্ষেপ। উল্লেখিত উভয় বেতন-স্কেল বৃদ্ধিকরণ দ্বারা চাকরিরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী কার্যক্রম হলেও পূর্ববর্তী বেতন-স্কেলে প্রাপ্ত টাকায় অবসরভোগীদের সুরক্ষায় কোন সমাধান ছিল না। শতভাগ পেনশন সমর্পণ প্রক্রিয়া সম্প্রতি বাতিল করা হয়েছে।
যে সকল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় বিধি অনুযায়ী তৎকালীন বেতন স্কেলের একশত মাসের (আট বছর চার মাস) প্রাপ্তব্য মাসিক মূল বেতনের ৮০% এককালীন পেয়ে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করে অবসরে গিয়েছিলেন, তারা বর্তমানে ভয়ানক অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। তখন এককালীন উত্তোলিত অর্থ, যা একশত মাসের মূল বেতনের ৮০% শতাংশ ছিল, তার পরিমাণ ছিল অত্যন্ত নগন্য যা বর্তমান বেতন-স্কেলে প্রাপ্তব্য মাত্র আট মাসের বেতনের সমতুল্য।
একত্রে উত্তোলিত উক্ত টাকা দ্বারা তাদের কোন উপকার সাধন তথা একত্রে উত্তোলনের উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার লভ্যাংশের হার পর্যায়ক্রমে চার ভাগের একভাগে নেমে আসায় এবং দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে একত্রে উত্তোলিত উক্ত টাকা নি:শেষ হয়ে তারা এখন অসহায় এবং দিশেহারা অবস্থায় আছেন। তৎকালীন বিধি বিধান অনুযায়ী শতভাগ পেনশন সমর্পণ করে তারা কোন দোষ করেন নাই। সমর্পণের বিধান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনে সংকট সৃষ্টির কারণ বিধায় উক্ত প্রক্রিয়া বর্তমানে বাতিলও করা হয়েছে।
দেশের জনগণের যে কোন সমস্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে তিনি তাৎক্ষণিক তার সমাধান প্রদান করেন। অনুরূপ চলমান সংকটের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক দয়ায় সমর্পিত পেনশন পুনর্বহাল হওয়া যৌক্তিক বিবেচনায় ইতিপূর্বে ২০১৮ খৃষ্টাব্দে শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের অবসরকাল ১৫ বছর পূর্ণতায় পেনশন পুনর্বহালের বিধান কার্যকর হয়। উল্লেখ্য যে, অবসর গ্রহণের পর খুব কম সংখ্যক লোক ১৫ বছর কাল জীবিত থাকেন। অতএব, এই বিধান মুষ্টিমেয় সংখ্যক পেনশন ভোগীদের উপকারে আসলেও অধিকাংশ অবসরভোগী উক্ত সুবিধা প্রাপ্তির পূর্বেই অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে থাকেন। বিপর্যস্ত অবস্থায় মৃত্যুর পূর্বে অসহায়ত্বের অবস্থা প্রকাশের সক্ষমতাও তাদের থাকে না।
লক্ষ্যণীয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দেশে অনেক গৃহহীনদের আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন। আর্থিক অনুদান প্রদান করত: অনেক অসহায় মানুষের জীবন রক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বিশ হাজার টাকা বৃদ্ধি করেছেন। পুলিশ সপ্তাহ-২০১৯ উপলক্ষে ভাষণে শতভাগ সমর্পণকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অবসরকাল দশ বছর পূর্ণতায় পেনশন পুনর্বহালের ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশদের জন্য আজীবন রেশন প্রদান করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা ছাড়া সফল পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল স্থাপন সহ দেশ এখন চতুর্মুখী উন্নয়নের চূড়ান্ত রোল মডেল হিসাবে বিশ্বে খ্যাত। এসব জনহিতকর এবং উন্নয়নমূলক কাজের একক কর্ণধার বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। দেশের জনগণের কল্যাণে এরূপ হাজারো মানবিক কৃতকর্মের উদাহরণ সৃজনকারী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অসহায় পেনশন সমর্পণকারী সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের একান্ত প্রত্যাশা, যেন অনতিবিলম্বে তাদের অবসর-কাল আট বছর পূর্ণতায় পেনশন পুনর্বহাল কার্যকর করার আদেশ প্রদানে মর্জি হয়।
বর্তমানে অসহায় অবস্থায় নিপতিত এসব অবসর ভোগীগণ একদা সরকারের নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা/কর্মচারী ছিলেন। তারাও রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহযোদ্ধা ছিলেন। সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের যথেষ্ট অবদান আছে। তারা এখন অসহায় অবস্থায় আছেন বিধায় দ্রুত গতিতে সরকারিভাবে আর্থিক সুরক্ষা প্রাপ্তির দাবীদার। বর্তমানে সমর্পণ প্রক্রিয়া বন্ধ বিধায় উক্তরূপ সুরক্ষা কার্যক্রম দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
অতএব, অবসর গ্রহণের পরবর্তী সময়কাল পনের বছরের স্থলে আট বছর পূর্তি বিবেচনায়, তৎপরবর্তী সময়ের জন্য প্রচলিত বিধি অনুযায়ী জরুরি ভিত্তিতে পেনশন পুনর্বহাল করা একান্ত প্রয়োজন, যা সময়ের দাবী এবং যৌক্তিক সমাধান। কর্তৃপক্ষের এরূপ গৃহীত পদক্ষেপ দ্বারা সামান্য ব্যয় বাড়বে, তবে সরকারি রাজস্বের উপর কোন বিরূপ প্রভাব পড়বে না বরং বর্তমান সরকারের প্রদেয় সহযোগিতা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার