শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের দুর্দশা

মোঃ শফিকুল আলম খান | মঙ্গলবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরী শেষে একজন চাকরীজীবী অবসরকালীন সময়ে মাসিক যে ভাতা পেয়ে থাকেন তাকে পেনশন বলে। সরকারি নিয়মানুযায়ী বর্তমানে কারো বয়স ৫৯বছর হলে তাকে চাকরী থেকে অবসর নিতে হয়। এর আগে অবসরের সময় ছিল ৫৭বছর। এলপিআর/ পিএলআর ভোগ শেষে মূল বেতন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে মাসিক পেনশন দেয়া হয়। তাছাড়া পঁচিশ বছর চাকুরি সম্পন্ন করে যে কেহ স্বেচ্ছায় চাকরী থেকে অবসর গ্রহন করতে পারেন। তিনিও মূল বেতন অনুযায়ী পুরো পেনশন পাবেন। তাছাড়া পাঁচ বছর থেকে চাকরীর বয়স অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট হারে পেনশন দেয়ার বিধানও প্রচলিত আছে।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের বেতন স্কেল অনুযায়ী অবসর গ্রহণকারীদেরকে মূল বেতনের নব্বই ভাগের অর্ধেক পেনশন দেয়া হয়। বাকী অর্ধেককে প্রতি টাকায় ২৩০ দিয়ে গুণ করে যে টাকা দাঁড়ায় তা এককালীন গ্র্যাচুয়িটি হিসেবে নগদে দেয়া হয়। যেমন একজন কর্মকর্তার অবসরকালীন সময়ে মূল বেতন ছিল ৬০,০০০টাকা। এর ৯০ ভাগের অর্ধেক সাতাশ হাজার টাকা তিনি মাসিক পেনশন পাবেন। আর বাকী অর্ধেকের জন্য প্রতি টাকায় ২৩০ টাকা করে ২৩৫০০ গুণ ২৩০=৫৪,০৫,০০০ টাকা এককালীন গ্র্যাচুয়িটি হিসেবে নগদে পাবেন। এছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমানো টাকা ফেরত পাবেন। অবসরগ্রহণকারী ব্যক্তি আমৃত্যু পেনশন পাবেন। তার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী জীবিত থাকলে বা প্রতিবন্ধী কোন সন্তান থাকলে তারাও পেনশন ভোগ করতে পারবেন।
২০০৯ বা এর আগে যারা অবসরে গেছেন তখনকার বেতন স্কেল অনুযায়ী তারা বর্তমানে প্রদেয় ৯০ ভাগের পরিবর্তে মূল বেতনের ৮০ ভাগের অর্ধেক পেনশন পাচ্ছেন এবং বাকি অর্ধেককে বতর্মানের ২৩০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা দিয়ে গুণ করে যে টাকা হয়েছিল তা গ্র্যাচুয়িটি হিসেবে নগদে পেয়েছেন। আগে আশি শতাংশ এবং দু’শ টাকা হার হওয়ায় পনের সালের আগে যারা অবসর নিয়েছেন তাদের সাথে পনের সালের পরে অবসর গ্রহণকারীদের পেনশন এবং গ্র্যাচুয়িটির পরিমাণে অনেক তারতম্য হয়েছে। তাছাড়া পনের সালের বেতন স্কেলে বেতন ভাতাও অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
১৯৯৪ সালে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করার বিষয়টি চালু করা হয়। বর্তমানে সেটা বাতিল করা হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করার কথা বলা হলেও এতে থেকে যায় শুভংকরের ফাঁকি। তখন শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী পেনশন সমর্পণ করে মূল বেতনের ৮০ ভাগের অর্ধেক প্রতি টাকায় ২০০ টাকা করে স্বাভাবিকভাবে পেয়েছেন। যা পেনশন সমর্পণ না করলেও তারা পেতেন। শতভাগ পেনশন সমর্পনের জন্য বাকী অর্ধেকে তারা পেয়েছেন আধা মূল্যে অর্থাৎ মাত্র ১০০ টাকা হারে যে টাকা হয়েছিল সেটাই। অর্থাৎ সে সময় একজন কর্মকর্তার মূল বেতন ত্রিশ হাজার টাকা হলে মূল বেতনের আশি ভাগ হিসেবে তা হয় চব্বিশ হাজার টাকা। এই টাকার অর্ধেক বারো হাজার টাকাকে দু’শ টাকা দিয়ে গুণ করে (১২০০০ গুণ ২০০)= ২৪,০০,০০০ ( চব্বিশ লাখ) টাকা যে কোন কর্মকর্তা পেনশন সমর্পণ করলে বা না করলেও গ্র্যাচুয়িটি হিসেবে এককালীন পাবেন। এছাড়া যিনি পেনশন সর্মপণ করেননি তিনি শুরুতে বারো হাজার টাকা করে মাসিক পেনশন পাচ্ছেন। আর যারা পেনশন সমর্পণ করেছেন তারা এই বারো হাজার টাকা আধা মূল্য অর্থাৎ ২০০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা দিয়ে গুণ করে (১২০০০ গুণ ১০০) = ১২,০০,০০০ (বারো লাখ) টাকা পেনশন সমর্পণের জন্য অতিরিক্ত পেয়েছেন। হিসেব করে দেখা গেছে এই টাকা আট বছর চার মাসের পেনশনের সমপরিমাণ। তাছাড়া সময় সময় সরকার ঘোষিত মহার্ঘ ভাতা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট যোগ করলে তা প্রায় ছয় বছরের পেনশনের সমান হয়।
এরপরেও অবসরের সময় বিভিন্ন কারনে অনেকের বেশি টাকা প্রয়োজন হওয়ায় বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে পেনশন অফিসে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতি মাসে পেনশন উত্তোলনের বিড়ম্বনা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য অনেকেই কম হলেও পুরো পেনশন তুলে নিয়েছেন। তাছাড়া অনেকেই ব্যাংকে বা সঞ্চয় পত্রে টাকা জমা রেখে প্রাপ্ত মুনাফা দিয়ে বাকী জীবন চালাবেন এ ধারণায় শতভাগ পেনশন সমর্পন করেন। কিন্তু তাদের জন্য তা হয়েছে হিতে বিপরীত। শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের কেউ কেউ তাদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে বা অন্য জরুরি প্রয়োজনে এবং কেহ কেহ অভিজ্ঞতা ছাড়া ব্যবসায় বিনিয়োগ করে সমর্পণকৃত টাকা খরচ করে ফেলেন। আর ব্যাংকে যারা টাকা জমা রেখেছেন তাতে মুনাফার হার কমতে কমতে বর্তমান এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যা দিয়ে তাদের ঔষধের মাসিক খরচও মিটে না।
জানা গেছে সারাদেশে এক লাখের সামান্য বেশি কমকর্তা/ কর্মচারী শতভাগ পেনশন সমর্পণ করেছেন। তারা মনে করেন পেনশন সমর্পণ করে যে টাকা একসাথে তারা পেয়েছিলেন তা একশ মাসের বা আট বছর চার মাসের পেনশনের সমপরিমাণ। ইতোমধ্যে তাদের এই টাকা সমন্বয় হয়ে গেছে। সে সময় তারা পেনশন সমর্পণ না করলে বিভিন্ন সময়ে প্রদেয় মহার্ঘ ভাতা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট যোগ করলে তাদের পেনশন দ্বিগুণের চেয়ে আরো অনেক বেশি হত।
শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীরা বতর্মানে খুবই দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে তারা অন্য কোন কাজ করতে পারছে না। যার ফলে তারা দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। তাই তারা দীর্ঘদিন যাবত আট বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাদের পেনশন পুনঃস্থাপনের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানিয়ে আসছিল ।
জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শতভাগ পেনশন সমর্পনকারীদের দুঃখ দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তা পনেরো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় স্থাপনের নির্দেশ দেন যা সতের সালের জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় একজন মানুষ কত বছর বাঁচে? অবসরের পর পনেরো বছরের এই সুবিধা পেতে হলে তাকে চুয়াত্তর বছর বেঁচে থাকতে হবে।
পেনশন সমর্পণকারীগণ রাষ্ট্রের খুবই প্রবীণ নাগরিক। সারা জীবন তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করেছেন। শ্রম ও মেধা দিয়ে তারা এদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তারা এখন বড়ই অসহায়। ভীষণ আর্থিক সংকটে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমান সরকার বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। তেমনি মাত্র ষাট/ সত্তর হাজার শতভাগ পেনশন সর্মপণকারীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে তাদের পেনশন পনেরো বছরের স্থলে আট/ দশ বছরে নির্ধারণ করলে বাজেটে তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং পেনশন সমর্পণকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ এই বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা হলেও তৃপ্তির হাসি নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারবে।
লেখক : বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

পূর্ববর্তী নিবন্ধবড়াই
পরবর্তী নিবন্ধআমার স্মৃতিতে শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ আমিন ও কারেন্ট বুক সেন্টার