শতবর্ষ পেরিয়ে ভাঙার গান

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৭ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

বাংলাসাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন ধুমকেতুর মতো। ছোটবড়ো সবার জন্য তিনি লিখেছেন। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি পদচারণা করেননি। সবখানেই তিনি প্রোজ্জ্বল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার, সংগঠক, নাট্যকার, সুরকারসহ নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল অবাধ। সর্বোপরি তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি হিসেবেও আখ্যা দেয়া যায়।

নজরুলের অনন্য সৃষ্টি ‘ভাঙার গান।’ ১৯২৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি। বিদ্রোহী কবির জীবনে রয়েছে আগস্ট মাসের অনেক গল্প, এই আগস্টে কবি প্রয়াত হন। ‘ভাঙার গান’ প্রকাশের মাত্র মাস তিনেকের মাথায় গ্রন্থটি ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় সরকার চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়। ব্রিটিশ শাসন অবসানের আগে গ্রন্থটি পুনরায় প্রকাশের মুখ দেখেনি। ‘ভাঙার গান’ গীতিকাব্য গ্রন্থের প্রথম গানটি হলো ‘কারার ঐ লৌহকপাট’এটিকেই কবি নাম দিয়েছেন ‘ভাঙার গান’। কবিবন্ধু মুজাফ্‌ফর আহমদের ভাষ্য মতে, ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থাকারে প্রকাশের বছর তিনেক আগেই এটি রচিত হয়েছিল। এটি ১৯২১ সালে ২০ জানুয়ারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী সম্পাদিত ‘বাঙলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সেসময় চিত্তরঞ্জন দাশ জেলে ছিলেন। ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অধিকাংশ জাতীয় উদ্দীপনামূলক গানকোরাস ও গণসংগীত এবং অধিকাংশ রচনার সঙ্গে তৎকালীন সময়ের পটভূমি যুক্ত হয়ে আছে। বিদ্রোহী প্রকাশের আগেই এই বইয়ের অধিকাংশ গান, কবিতা গণসংগীত রূপে বিভিন্ন সভাসমিতিতে এমনকি রাজপথে কবি নিজে গেয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। খেলাফত ও অসহযোগ অন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনে নজরুলের এই গানকবিতা মুক্তিকামী মানুষের বুকে আশার সঞ্চার করে এবং ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে তাদের একত্রিত করতে সহায়তা করে।

নজরুলের রচনা বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলনকে করেছে শাণিত। আন্দোলনের তোপের মুখে কোনো স্বৈরশাসক টিকে থাকতে পারেনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল শত্রুদের ঘায়েল করতে। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নজরুল ছিলেন অন্যতম প্রেরণাদাতা। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল নজরুলের সে বিখ্যাত গান -‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল, কররে লোপাট রক্তজমাট/ শিকলপূজার পাষাণবেদী/ ওরে ও তরুণ ঈশান!/ বাজা তোর প্রলয়বিষাণ ধ্বংসনিশান/ উড়ুক প্রাচীর, প্রাচীর ভেদি/ গাজনের বাজনা বাজা!/ কে মালিক? কে সে রাজা/ কে দেয় সাজা/ মুক্তস্বাধীন সত্য কে রে/ হা হা হা পায় যে হাসি/ ভগবান পরবে ফাঁসি/ লাথি মার ভাঙরে তালা/ যত সব বন্দীশালায় আগুন জ্বালা/ আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।’

১৯৪৯ সালে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ রেকর্ড করা হয়। গানটি গেয়েছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে গানটি বের হয়। জহির রায়হান তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেছেন, সেখানে সুরের ব্যঞ্জনা রক্তে আগুন খেলে যায়। ’৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে সিনেমাটি নির্মিত। মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে।

নজরুল রচনা’র একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিদ্রোহ আর প্রতিবাদ। অক্ষরে অক্ষরে, শব্দে শব্দে নবসৃষ্টির উল্লাসে শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য ও কুসংস্কারের প্রতিবাদ করেছেন তিনি। যাঁর রেশ এসে পৌঁছেছে গানেও। প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও দ্রোহে যুগে যুগে এ গান, গানের বাণী উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে প্রতিবাদের প্রতিরূপ হিসেবে গানটি পরিচিত হলেও নজরুল এটি লিখেছিলেন কবিতা হিসেবে।

নজরুল নবযুগ ও ধূমকেতু সংবাদপত্রে জাতিকে উজ্জীবিত করার জন্য অনেক প্রবন্ধ, কবিতা লিখেছেন। অন্যায়অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী নবযুগের সৃষ্টি করেছে। নজরুলের রচনা যুগে যুগে আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছে। শতবর্ষ পেরিয়ে ‘ভাঙার গান’ আজও আমাদের উদ্বেলিত করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঢাকায় রেললাইনে তরুণীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, প্রেমিক গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রজ্ঞার ভাগ্য বিড়াল