শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি : তৃপ্তি মিত্র

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ভূমিকন্যা কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী তৃপ্তি মিত্র। বিশ্বনাট্য জগতে তাঁর অবদান শ্রদ্ধাভরে স্বীকৃত হলেও জন্মভূমিতে তিনি নিতান্তই স্বল্পপরিচিত। সত্যিকার অর্থে স্বল্প পরিচিতও নন। নাট্যসংশ্লিষ্ট নবীন প্রবীণ অনেকের সঙ্গে আলাপে জেনেছি তাঁরা তৃপ্তি মিত্রকে চেনেন না। অথচ নব নাট্য আন্দোলন ও আধুনিক নাট্যচর্চায় তৃপ্তি মিত্র অনিবার্য ও অবিস্মরণীয় একটি নাম। কিংবদন্তি স্বামী শম্ভু মিত্রের সাধনসঙ্গী ও বহুরূপী নাট্যদলের নিয়মিত অভিনেত্রী হয়ে উপহার দিয়েছেন কালজয়ী অনেক নাট্য অভিনয়। অভিনয় করেছেন নির্বাচিত বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। লিখেছেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন অনেক নাটক। অতিথি প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন বেতার নাটকে। জীবনের শেষ পর্যায়ে বহুরূপী থেকে সরে এসে গড়েছিলেন নিজের নাট্যদল-‘আরদ্ধ নাট্য নিকেতন।’ এই নাট্য মহিয়সীর জন্ম শতবর্ষ ২০২৫ নীরবে নিভৃতে অতিবাহিত হচ্ছে তার নিজের দেশে।

তৃপ্তি ভাদুড়ীর জন্ম ১৯২৫ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলা শহরে (তখন দিনাজপুর জেলার মহকুমা)। ডাক নাম মনি। ভাদুড়ী পরিবার ছিল ঠাকুরগাঁওয়ের সম্ভ্রান্ত এক সাংস্কৃতিক পরিবার। এই পরিবারের দুই কন্যা শান্তি ও তৃপ্তি ছোট শহরটির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যথেষ্ট সমাদৃত ছিলেন। তৃপ্তির বড়বোন শান্তি পরবর্তীকালে কলকাতায় সাংস্কৃতিকচর্চায় নানাভাবে সংযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কবি অরুণ মিত্রের সঙ্গে। আরেক কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভটাচার্য ছিলেন শান্তি ও তৃপ্তির মাসতুতো (খালাতো) দাদা।

তৃপ্তি মিত্রের প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা দিনাজপুর মাইনর স্কুলে। পরবর্তীকালে কলকাতার স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন ১৯৪৩ সালে। এরপর কলেজে ভর্তি হলেও পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা আর এগিয়ে নিতে পারেননি। সরকারি প্রতিষ্ঠান এ.আরপিতে চাকরি নিতে হয়। তবে কলেজে পড়াকালীন বামপন্থী রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। সদস্য হন ছাত্র ফেডারেশনের। এই রাজনৈতিক সম্পৃক্তিলব্ধ সচেতনতা পরবর্তী জীবনে তাঁর সামগ্রিক শিল্পজীবনে সঞ্চারিত ছিল।

কলেজে পড়াকালীন সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় শুরু করেন। এরপর তিনি তাঁর মাসতুতো দাদা বিজন ভট্টাচার্যের উদ্যোগে যুক্ত হন প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে। অভিনয় করেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ) প্রযোজিত আগুন নাটকে। আইপিটিএএর পরবর্তী প্রযোজনা ল্যাবরেটরি, নবান্ন জবানবন্দী, মুক্তধারা প্রভৃতি নাটকেও তৃপ্তি অভিনয় করেন। তাঁর সহ কলাকুশলী ছিলেন শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, বিজন ভট্টাচার্য, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, কলিম শরাফী প্রমুখ। গণনাট্য সংঘে অভিনয়ের সূত্র ধরে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় এবং পরিণয়। তৃপ্তি ভাদুড়ী থেকে হন তৃপ্তি মিত্র। জননী হন যশস্বী অভিনেত্রী, নাট্যকার ও নির্দেশক শাঁওলী মিত্রের।

১৯৪৬ সালে গণনাট্য সংঘ প্রযোজিত ও খাজা আহম্মদ আব্বাস পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ধরতিকে লাল’এর মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন তৃপ্তি। এটি ছিল তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রাভিনয়। এরপরে গুরুত্বপূর্ণ অনেক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পথিক (১৯৫৩), ময়লা কাগজ (৫৪), রিকশাওয়ালা (৫৫), শুভ বিবাহ (৫৯), মানিক (৬১), জয় মা কালী বোর্ডিং (৫৫), কাঞ্চনরঙ্গ (৬৪), যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪, মুক্তি ১৯৭৭)। মূলত নাটকে ব্যস্ততার কারণে চলচ্চিত্রে তেমন সময় দিতে পারেননি এটা বোঝা যায়। নাটক এবং চলচ্চিত্রের অভিনয়ের পার্থক্যটা তিনি সাবলীলভাবেই অনুধাবন করতে পারঙ্গম ছিলেন। এটা তাঁর এই দুই মাধ্যমের অভিনয়ে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে ঋত্বিককুমার ঘটক পরিচালিত যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে ঋত্বিকের বিপরীতে দুর্গা চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রের অসাধারণ মেথড অ্যাকটিং আন্ডার টোনাল অভিনয়ের এক পরম দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। এ ছবিতে বঙ্গবালা নামের এক বাংলাদেশি শরণার্থী তরুণীর চরিত্রের মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছিলেন শম্ভুতৃপ্তি তনয়া শাঁওলী মিত্র। নাট্য জগতের বিরলপ্রজ অভিনেত্রী ও নাট্যকার শাঁওলীর এটিই একমাত্র চলচ্চিত্রাভিনয়। তেমনি ঋত্বিকের পরিচালিত এবং তৃপ্তির অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিলযুক্তি তক্কো আর গপ্পো।

১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নাট্যদল বহুরূপী। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, মহম্মদ ইসরাইল, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, কলিম শরাফী এবং তৃপ্তি মিত্র। প্রথম মঞ্চস্থ নাটক ছিলনবান্ন। ১৯৪৮ সালে মঞ্চস্থ এ নাটকের মূল নারী চরিত্রে অভিনয় করেন তৃপ্তি মিত্র। বহুরূপীর নির্ভরযোগ্য অভিনেত্রী হিসেবে প্রচুর নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছেঁড়া তার, চার অধ্যায়, রক্তকরবী, ঘরে বাইরে, পুতুল খেলা, অপরাজিতা, কিংবদন্তি ইত্যাদি। বহুরূপীর প্রযোজনায় অনেক নাটক তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডাকঘর, ঘরে বাইরে, কিংবদন্তি এবং অপরাজিতা। তৃপ্তির নাট্যাভিনয়ের একটি স্মরণীয় কীর্তি অপরাজিতা নাটকে তাঁর অনবদ্য এককাভিনয়। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে এই নাট্যাভিনয় উপস্থাপন করে গিয়েছিল। পেশাদার মঞ্চেও তিনি অভিনয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য নাটক ; সেতু, বিরাজ বৌ, গৃহলক্ষী থানা থেকে আসছি, বিপ্রদাস। বেতার, টিভি ও গ্রামোফোন রেকর্ডেও অভিনয় করেছেন তৃপ্তি মিত্র। বেতারের জন্যে সত্যজিৎ রায়ের ফটিকচাঁদ গল্পটির সফল নাট্যরূপও দিয়েছিলেন। টেলিভিশনে তাঁর স্মরণীয় অভিনয় অপরাজিতা ও সরীসৃতা। সরীসৃপ নাটকটির রচয়িতা ছিলেন বিধায় ভট্টাচার্য। সব মিলিয়ে নাট্যক্ষেত্রে তৃপ্তি মিত্রের সামগ্রিক অবদান ছিল অপরিসীম ও চিরস্মরণীয়।

কিন্তু এত বড় একজন শিল্পীকেও জীবনের শেষ দশকে অনেক অপমান আর উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছিল। যে নাট্যদলের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠিাতা, পরিবারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে অবলীলায় যে দলের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন, ১৯৮০ সালে সেই বহুরূপী দলের সাংগঠনিক বিরোধের কারণে তিনি দল ছড়াতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে বহুরূপী থেকে শম্ভু মিত্র এবং শাঁওলী মিত্রও বেরিয়ে আসেন এই একই কারণে। তৃপ্তি মিত্র নিজের আরেকটি নাট্যদল গড়েনআরব্ধ নাট্য নিকেতন। সে দলটিও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং অনেক সফল নাট্য প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে।

তৃপ্তি মিত্রের শিল্পী জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কৃতি, ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যের যৌথ প্রযোজনায় এ.জে. কারাদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে অভিনয়। ঢাকার এফডিসি থেকে প্রথম নির্মিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এ ছবিতে তৃপ্তি কপিলা চরিত্রে অভিনয় করেন খান আতাউর রহমানের (আনিস) বিপরীতে।

তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল অননুকরণীয় বাচিক ও দৈহিক অভিনয়। কন্ঠের অনবদ্য মডিউলিশন এবং পুরো শরীরকে ব্যবহার করে তিনি অনন্য এক অভিনয় শৈলীর উপস্থাপন ঘটাতেন। যার অনুকরণ ও অনুসরণ রীতিমতো দুঃসাধ্য। এই অভিনয় শৈলীর কিছুটা প্রভাব ও প্রয়োগ পরিবর্তী সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁর কন্যা শাঁওলী মিত্রের অভিনয়ে।

তৃপ্তি মিত্র অভিনীত চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলি নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের নয়। প্রতিটি চরিত্র শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষের। যুক্তিতক্কো আর গপ্পো ছবির দুর্গা চরিত্র, যেটি ঋত্বিকের স্ত্রী সুরমা ঘটকের আদলে রচিত, সে চরিত্রটিও সংগ্রামী এক নারীর। তবে নাটকে তিনি বিভিন্ন ধরনের চরিত্র রূপায়ন করেছেন এবং অত্যন্ত স্বচ্ছন্দভাবে সেসব চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে প্রাণসঞ্চার করতেন যার ফলে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি পুরো নাটকের ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতো। দৃষ্টান্ত স্বরূপ চার অধ্যায়ের এলা, রক্তকরবীর নন্দিনী, পুতুল খেলার বুলু, বিরাজ বৌয়ের বিরাজ, ঘরে বাইরের বিমল, ছেঁড়া তার ও সরীসৃপের অসহায় দুই নারী চরিত্রের উল্লেখ যথার্থই প্রাসঙ্গিক। নাট্যরচনাকেও দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। সবগুলি নাটক গ্রন্থিত হয়েছে সমগ্র আকারে। সরকারি বেসরকারি বহু পুরস্কারে সম্মানিত শিল্পী ১৯৮০৮১ মেয়াদে বিশ্বভারতীর ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। কীর্তিময়ী এই মহাশিল্পীর প্রয়াণ ঘটে ১৯৮৯ সালের ২৪ মে কলকাতা মাত্র ৬৪ বছর বয়সে।

জন্মশতবর্ষে মহিয়ষী নাট্যসম্রাজ্ঞী তৃপ্তি মিত্রের প্রতি তাঁর জন্মভূমি থেকে আমাদের করপুট শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী
পরবর্তী নিবন্ধতারেক রহমানের আগমনের মধ্য দিয়ে সকল ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটবে