শতবর্ষে আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট : ৫০ পেরিয়ে জশনে জুলুছ ও মাসিক তরজুমান
মুহাম্মদ ওসমান গনি চৌধুরী (অভীক ওসমান)
আওলাদে রাসূল, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত ওলী। মুহাক্কিক আলেম, তরীকতের শায়খ এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাআতের আক্বীদা ও বিশ্বাসের প্রচারক ছিলেন। তিনি অসাধারণ জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী চিন্তাশক্তি দ্বারা শরীয়ত, তরীকত ও আহলে সুন্নাতের প্রচার–প্রসারে গড়ে তুলেন সংস্থা, মাদ্রাসা ও খানকাহ শরীফ। যা বর্তমানে সারা পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ইসলামের প্রচার–প্রসারকল্পে ১৯২৫ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমান–এ শুরা–এ রহমানিয়া’। ২২ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে এ সংস্থাটি পুনঃগঠন করা হয়। চট্টগ্রাম এবং দেশের অন্যান্য স্থানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা, খানকাহ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামকরণ করা হয়। এর কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ৩৯ আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রামে। পরবর্তী ১৮ মার্চ ১৯৫৬ সালে আনজুমানকে অরাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জনহিতকর সংগঠন হিসেবে ‘আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’ নামে পুনঃগঠন করা হয়। যা দেশের সুন্নী মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ধর্মীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।
আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ১৮৬০ সালের রেজিষ্ট্রেশন অফ সোসাইটিজ অ্যাক্ট XXI এর অধীনে যথাযথভাবে নিবন্ধিত হয়। এর রেজিষ্ট্রেশন নং ১২৩৭ EP/৮২, ১৯৫৮–৫৯. (CHS- ১২৩৭)। আনজুমান মানে সংস্থা/সংগঠন, রহমানিয়া নেওয়া হয়েছে হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)-এর নাম থেকে, আহমদিয়া নেওয়া হয়েছে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)-এর নাম থেকে, সুন্নিয়া নেওয়া হয়েছে সুন্নিয়তের পরিচয়ের জন্য এবং ট্রাস্ট হল কল্যাণের প্রতীক। এ সংগঠনের নিবন্ধিত অফিস জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ভবন, পশ্চিম ষোলশহর, চট্টগ্রামে এবং প্রিন্সিপাল অফিস ৩২১, দিদার মার্কেট, দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রামে অবস্থিত। এ ট্রাস্টের অধীনে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়। পরে রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদ্রাসা, চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসা–এ তৈয়বিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল, হালিশহর মাদ্রাসা–এ তৈয়বিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম, ঢাকা, কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় দেড় শতাধিক মাদ্রাসা, খানকাহ ও মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে।
১৯৭৪ সাল থেকে আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট কর্তৃক চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) উপলক্ষে জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ জুলুছ এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং প্রধান ধর্মীয় র্যালির স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আনজুমান কর্তৃক প্রকাশিত হয় মাসিক তরজুমান–এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাআত, প্রতিষ্ঠা করা হয় আনজুমান রিসার্চ সেন্টার। এ ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হয় একমাত্র অরাজনৈতিক ধর্মীয় অঙ্গসংগঠন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’। যুগের চাহিদা অনুযায়ী হযরাতে কেরামের নির্দেশনায় আনজুমান কর্তৃক ‘দাওয়াতে খায়র’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। গাউসিয়া কমিটির মহিলা শাখা কাজ করে যাচ্ছে।
জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) : পঞ্চাশ পেরিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পূর্ণতায়
বাংলাদেশে ইসলামি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আজ সুপরিচিত এক অনন্য আয়োজন। এর সূচনা ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। সে বছর গাউসে জামান, আওলাদে রাসূল, রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দরবারে আলিয়া সিরিকোট শরীফ থেকে প্রেরিত চিঠিতে আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ১২ রবিউল আউয়াল শরীফে আনুষ্ঠানিক জশনে জুলুছ পালনের জন্য। একই বছরের ১২ রবিউল আউয়ালে চট্টগ্রামের বলুয়ারদীঘি খানকাহ শরীফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম জুলুছ অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক তিনি নিজেই চট্টগ্রাম ও ঢাকার জুলুছের নেতৃত্ব দেন। পরে তাঁর ইন্তেকালের পর সাজ্জাদানশীন দরবারে আলিয়া সিরিকোটের বর্তমান হুজুর, আওলাদে রাসূল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) নিয়মিত বাংলাদেশে আগমন করে ধারাবাহিকভাবে জুলুছ পরিচালনা করেন। এ সময়ে জুলুছে মানুষের অংশগ্রহণ এত বেড়ে যায় যে বলুয়ারদীঘি এলাকায় স্থান সংকুলান সম্ভব হয়নি। ফলে বর্তমান হুজুর কেবলার অনুমতিতে এর সূচনা ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান স্থানান্তরিত হয় ষোলশহর আলমগীর খানকাহ শরীফ ও জামেয়া–সংলগ্ন জুলুছ মাঠে। এ বছর (হিজরি হিসাবে) জশনে জুলুছ ৫৪তম বর্ষে পদার্পণ করছে। বিগত অর্ধশতকেরও বেশি সময়ে এ জুলুছ বাংলাদেশের ইতিহাস ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে গণমাধ্যমে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৫০–৭০ লাখ হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। ২০২৪ সালে আয়োজিত জুলুছ–পরবর্তী মাহফিলে পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ (মু.জি.আ.) উল্লেখ করেন, অন্তত ৭০ লাখ মানুষ এতে শরিক হয়েছেন। বর্তমানে সচেতন মহল একে বিশ্বের বৃহত্তম জশনে জুলুছ হিসেবে আখ্যায়িত করছে। এমনকি একে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস–এ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে।
এ জুলুছ আর শুধু চট্টগ্রাম–ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। এখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, কাচালং থেকে জৈন্তিয়া সর্বত্র রবিউল আউয়াল এলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা জশনে জুলুছের মাধ্যমে নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) মোবারক জন্মদিন উদ্যাপন করেন। শুধু বাংলাদেশই নয়, বর্তমানে ৪৮টি দেশের কিছু জায়গায় সরকারিভাবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাউসিয়া কমিটির ব্যানারে জশনে জুলুছ পালিত হচ্ছে। এভাবে জুলুছ এক জাতীয় আয়োজন থেকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে পালিত হয়ে আসছে জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। এটি বাংলাদেশের ইতিহাস ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে এবং আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত হয়েছে। ভবিষ্যতে একে বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ জশনে জুলুছের ফয়েজ–বরকত দান করুন। আমিন।
মাসিক তরজুমানের ৫০ বছর
আওলাদে রাসূল রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরিকত মুর্শিদে বরহক আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নির্দেশে আনজুমান–এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র উদ্যোগে ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক তরজুমান–এ আহলে সুন্নাত প্রকাশ হয় ১৩৯৭ হিজরীর মুহাররম মাসে।
আক্বায়িদে আহলে সুন্নাতের আলোকে ধর্মীয় জ্ঞান দান, নৈতিক অবক্ষয় রোধ, বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি, পবিত্র কোরআন–হাদীসের আলোকে শরীয়ত–তরীক্বতের সমন্বয়ে পরিশুদ্ধ খাঁটি দ্বীনদার মুমিন মুসলিম সমাজ তৈরীতে নিয়োজিত রয়েছে মাসিক তরজুমান। বাতিল মতবাদিদের প্রকাশিত যে কোন পত্র–পত্রিকা, বই–পুস্তকের আক্বিদা বিরোধী সকল অপপ্রচারের দাঁংতভাঙ্গা জবাব পবিত্র ক্বোরআন–হাদীসের আলোকে পেশ করে আসছে মাসিক তরজুমান। মাসিক তরজুমানের প্রতিষ্ঠাতা আওলাদে রাসূল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি–এর এক অমূল্যবাণী স্মরণ করে দিতে চাই।
হুজুর কিবলা বলেছেন– ‘‘আশেকানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কেলিয়ে তরজুমান খরিদনা, পড়না জরুরি হ্যায়।’’ অর্থাৎ– নবীপ্রেমিকদের জন্য তরজুমান ক্রয় করা ও পড়া অপরিহার্য। হজুর কেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রতিষ্ঠিত এ পত্রিকা যদি এ সিলসিলার লাখ–লাখ মুরিদগণ নিয়মিত সংগ্রহ ও পাঠ করেন, নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজে গ্রাহক হয়ে অপরকে গ্রাহক হতে উৎসাহ্ দেন তাহলে এ তরজুমানের গ্রাহক ধারণাতীত বৃদ্ধি পাবে। আমরা সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম। মহান আল্লাহ্ মাশায়েখ হযরাতের ওসীলায় আমাদের কামিয়াব করুন–আ–মী–ন।
মাসিক তরজুমানের ৫০ বছর পূর্তিতে দেশ–বিদেশের সকল লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
নির্বাহী সম্পাদক : মাসিক তরজুমান।
সাবেক সচিব, চিটাগাং চেম্বার এন্ড কমার্স।