টাইগারপাস–সিআরবির শতবর্ষী গাছ ও সড়ক ধবংস করে র্যাম্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল না করলে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। ‘গাছ বাঁচাও, চট্টগ্রাম বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে গতকাল সোমবার বিকালে টাইগারপাস মোড়ে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা আসে। এতে বলা হয়, টাইগারপাস–সিআরবির শতবর্ষী গাছ কাটা যাবে না এবং চট্টগ্রামের একমাত্র দ্বিতল সড়কটি অক্ষত রাখতে হবে।
এই সংগঠনের নেতৃত্বে ২০১১ সাল থেকে টানা ১৫ মাসের আন্দোলনে সিআরবিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প বাতিল হয়েছিল। টাইগারপাস থেকে সিআরবিমুখী পাহাড়ি রাস্তাটির মাঝের ঢালে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় সিডিএ। সেজন্য জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে রেলওয়ের কাছে এবং পাহাড়ের ঢালে থাকা ৪৪টি গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে বন বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
টাইগারপাস মোড়ে শতবর্ষী গাছের নিচে এই সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান বলেন, যদি র্যাম্প করতে হয়, অনেক জায়গা আছে এখানে। গাছ কেটে কেন করতে হবে? প্রকৃতি অক্ষুণ্ন রেখে যে কোনো কিছু করতে পারে, তারা সেটা করুক।
তিনি বলেন, মূল লক্ষ্য এসব শতবর্ষী গাছ ও দ্বিতল রাস্তাটি নষ্ট করে সিআরবির পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করা। তারপর সিআরবিতে থাবা বসানো। শতবর্ষী গাছ কেটে নতুন চারা লাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, এই সড়ক শুধু চট্টগ্রামের নয়, দেশের ও বিশ্ব প্রকৃতির সম্পদ। যা সৃষ্টি করতে পারবেন না তা কেন ধ্বংস করছেন? প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে এই সম্পদ রক্ষার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, অবিলম্বে সিডিএ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘোষণা দিন। নিউ মার্কেট থেকে এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে ব্যবহারের অনেক বিকল্প আছে।
সভাপতির বক্তব্যে নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজি বলেন, এত বিকল্প থাকতে কেন গাছ কেটে আর দ্বিতল রাস্তা ধ্বংস করে র্যাম্প করতে হবে সেটা বোধগম্য নয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, আমরা কেউ উন্নয়ন বিরোধী নই। এই র্যাম্প এখানে কেন? এই এলিভেটেড এঙপ্রেসওয়ে করার সময়ও শুরুর স্থান নিয়ে সমস্যা হয়। এটা দেওযানহাট থেকে শুরু করা যেত। তা না করে পাহাড় কেটে লালখান বাজার থেকেই শুরু করা হয়। নতুন করে গাছ রোপণ করবেন বলছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী। আপনি কি এ রকম একটি দ্বিতল সড়ক করতে পারবেন? এই শতবর্ষী গাছ ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
সাংবাদিক প্রীতম দাশের সঞ্চালনায় সমাবেশে সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি চৌধুরী ফরিদ, সাংবাদিক ঋত্বিক নয়ন, আমিনুল ইসলাম মুন্না ও সারোয়ার আমিন বাবু, নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম, খাল নদী রক্ষা কমিটির আলীউর রহমান, লেখিকা মোহছেনা ঝর্ণা, অধ্যাপক সুপ্রতীম বড়ুয়া, পিপলস ভয়েস–এর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, যুব নেতা শিবু চৌধুরী, সাংবাদিক মিনহাজুল ইসলাম, কায়সার চৌধুরী, সাংস্কৃতিক সংগঠক মোরশেদুল আলম চৌধুরী, বনবিহারী চক্রবর্তী, সংগঠক সাজ্জাদ হোসেন জাফর, রুবেল দাশ প্রিন্স, গণণমাধ্যম কর্মী কামরুজ্জামান রনি, রাজনীতিবিদ রাহুল দত্ত, সংগঠক সৌমেন দাশ, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মো সাইমুম। প্রতিবাদী ছড়া পাঠ করেন উৎপল বড়ুয়া।
গাছ আপনার কী ক্ষতি করে? : এর আগে দুপুরে আরেকটি শতবর্ষী গাছের নিচে কর্মসূচি পালন করে সম্মিলিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন। এতে অংশগ্রহণকারীদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বেঁচে থাকা গাছ আপনার কী ক্ষতি করে’, ‘উন্নয়নের করাত থেকে গাছেদের মুক্তি দাও’, ‘এসব মহিরুহ আমাদের প্রাণ’, ‘গাছ কাটার আগে আমাদের কাট’ ইত্যাদি।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান বলেন, প্রকৃতি থেকে যে আমরা নানা সুবিধা পাই, এসব নিয়ে তাদের জানাশোনা, জ্ঞান নেই। এসব জায়গায় যারা বসেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
সিপিবির বিবৃতি : এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক অশোক সাহা ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, প্রকৃতির ছায়াঘেরা এই নান্দনিক জায়গাটিকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে ক্ষতবিক্ষত করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে। এ সংবাদ জানার পর থেকে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমরাও সিডিএর এ উদ্যোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
বিবৃতিতে বলা হয়, সিডিএর কাজ হওয়া উচিত ছিল এ শহরকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নজরদারি রাখা। ইতিহাস–ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। তারাই আজ হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলন : সিডিএর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়কারী হাসান মারুফ রুমী, নির্বাহী সমন্বয়কারী ফরহাদ জামান জনি, মহানগর শাখার আহ্বায়ক অপূর্ব নাথ ও সদস্য সচিব মিজানূর রহীম চৌধুরী। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, সিআরবির নিকটে টাইগারপাসের যে অংশটিতে সিডিএ গাছ কেটে নির্মাণ পরিকল্পনা করছে, সিডিএর প্ল্যান অনুযায়ী এই এলাকা ঐতিহ্য ও পরিবেশগত কারণে বিশেষভাবে সংরক্ষিত। এই এলাকা এবং এখানকার শতবর্ষী গাছগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণ করে যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আমরা বিরোধী নই। তবে কোনোভাবেই পরিবেশ ধ্বংস করে, গাছ নিধন করে উন্নয়ন চট্টগ্রামবাসী চায় না এবং চট্টগ্রামবাসী তা মেনে নিবে না।