শঙ্খে নাব্যতা ফেরানোই চ্যালেঞ্জ

প্রতিরক্ষা বাঁধ ও ড্রেজিং শেষ হলে নৌ-বাণিজ্য বাড়বে বাঁচবে জেলে, পর্যটনে জাগবে সম্ভাবনা

চন্দনাইশ প্রতিনিধি | বুধবার , ২ জুন, ২০২১ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর পর চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী হলো শঙ্খ। মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা মদক পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়েছে এই নদীর। এর দৈর্ঘ্য ২৭০ কিলোমিটার। সর্পিলাকার নদীটি বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবান সদর হয়ে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলা সীমানার মধ্যদিয়ে বাঁশখালীর খানখানাবাদ এবং আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর হয়ে কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে। বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্টের এ নদীর কোনো শাখা নেই। বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়া প্রায় সব নদীতেই লবণের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলেও একমাত্র শঙ্খে লবণ নেই। ১৮৬০ সালে তৎকালীন ইংরেজ সরকার গেজেটভুক্ত করে এই নদীর নাম রাখে সাঙ্গু রিভার। তবে বান্দরবানের আদিবাসীরা এ নদীকে বলে, রিগ্রাই থিয়াং, মানে স্বচ্ছ নদী। এ নদীর পানি এতই স্বচ্ছ যে, তৎকালীন নলকূপসহ বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতার কারণে মানুষ এই নদীর পানি ব্যবহার ও পান করত। পাহাড়ি আদিবাসীরা এখনো এই নদীর পানি পান করে। নদীর দুই কূলে লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিতে ধান ও সবজি চাষ হয় এ নদীর পানিতে। এছাড়া আদিকাল থেকেই ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে শঙ্খ ছিল প্রিয়। অথচ সেই নদী এখন মৃতপ্রায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর দুই কূল ভেঙে এবং পাহাড়ি বালি অবিরাম জমা হতে হতে চর তৈরি হয়েছে শঙ্খের বুকে। পলিমাটি ও বালি জমে ভরাট হয়ে আছে নদীর দুই পাশ। মাঝখানে পানির ক্ষীণধারা। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানি। দুই পাশের চরে চাষাবাদ করছেন স্থানীয় কৃষকরা। নদীর মাঝখানে ভেসে ওঠা চরে ফুটবলসহ নানা খেলায় মেতে ওঠে শিশু-কিশোররা। পাশাপাশি দখল ও দূষণে এই নদী এখন বিপর্যস্ত। অথচ বর্ষাকালে শঙ্খ ভয়ঙকর রূপ ধারণ করে। ভাঙনের শিকার হয় নদীঘেঁষা সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর বিস্তীর্ণ জনপদ। তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পুরো জনবসতি। ক্ষেত খামার, রাস্তাঘাট সবকিছুই তছনছ হয়ে যায়। এতে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী এ অঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল শঙ্খ। নদীপথে লবণ পরিবহনের সহজলভ্যতার কারণে দোহাজারীতে গড়ে উঠেছিল লবণ শিল্প। এখানে এখনো বেশ কয়েকটি লবণ মিল রয়েছে। নদীর প্রশস্ততা কম হলেও সেই সময় গভীরতা ছিল বেশি। সারা বছর পানি থাকত। বান্দরবান থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত যতগুলো বাণিজ্যিক স্থান ছিল প্রায় সবগুলোতেই অসংখ্য নৌকা, সাম্পান ও ইঞ্জিনচালিত বোটের দাপট ছিল। ভিড়ত ছোট ছোট বাণিজ্যিক জাহাজও। ব্যবসায়ীরা এসব নৌযানের সাহায্যে তাদের পণ্য সামগ্রী আনা-নেওয়া করতেন। নাব্যতা হারিয়ে ফেলায় এখন শঙ্খের অনেক জায়গায় ডিঙি নৌকাও চলতে পারছে না।
ইতোমধ্যে শঙ্খে প্রশস্ততা বেড়েছে। তবে কমেছে গভীরতা। ফলে শীত মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং হাজার হাজার মাঝি নৌকা চালাতে না পেরে বেকার হয়ে পড়েন। নৌ চলাচল ব্যাহত হওয়ায় নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ মাধ্যমও বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল নামলে নদী তার যৌবন ফিরে পায়। কালিয়াইশ এলাকার সাবেক মেম্বার এসএম জসিম উদ্দিন জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেখেছি, বান্দরবানসহ চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী থেকে শঙ্খ নদী পথে নৌযানের সাহায্যে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী দোহাজারীতে নিয়ে আসত। এখান থেকে সড়ক ও রেলপথে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। তেমনি বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দোহাজারী এসে সড়ক ও রেলপথে গন্থব্য স্থানে যেতেন। তাছাড়া নদী পার হওয়ার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল ঘাট। বর্তমানে নদীর নাব্যতা না থাকায় বৃষ্টি হলেই দুই কূল পানিতে ভেসে যায়। ঘরবাড়িতে পানি ওঠে। বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নষ্ট হয়ে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়। লোকজন ভোগান্তিতে পড়ে।
কাটগড় জলদাশ পাড়ার জেলে বলরাম জলদাশ জানান, বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু মাছের জন্য আদর্শ প্রজনন ক্ষেত্র মিঠা পানির নদী শঙ্খ। এই নদীর মাছ আহরণ করে তার পূর্বপুরুষসহ হাজার হাজার জেলে পরিবার জীবন ধারণ করেছেন। চিংড়ি, চিরিং, বাইলা, বোয়াল, রুই, কাতাল, পাঙ্গাস, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। সেই চিত্র এখন আর দেখা যায় না। বিগত কয়েক বছর ধরে এক শ্রেণীর ব্যক্তি নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেছে। এছাড়া নদীর দুই তীরে উৎপাদিত সবজি ক্ষেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মাছের পোনা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে শঙ্খ নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শঙ্খের নাব্যতা ফিরিয়ে আনাই এখন চ্যালেঞ্জ। নাব্যতা ফিরিয়ে আনা গেলে নদীপাড়ের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ কমবে এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে তোলা যাবে একটি নৌ-বাণিজ্য কেন্দ্র। এ অবস্থায় নদী শাসনের মাধ্যমে যেসব স্থানে এখনো প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়নি, সেসব স্থানে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে শঙ্খ নদী তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। নদীর বুকে আবার সৃষ্টি হবে নৌ-পথ। এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পায়ন। পাশাপাশি জেলে ও মাঝিদের জীবন-জীবিকাও রক্ষা পাবে। এছাড়া পাহাড় ঘেরা এই নদীকে ঘিরে উন্মোচিত হবে পর্যটনের অপার সম্ভাবনাও।
সংসদ সদস্য মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, শঙ্খ নদী ছিল দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু যুগের পর যুগ পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা বালি, দুই কূল ভাঙার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলেও কোনো জনপ্রতিনিধি শঙ্খের ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যার খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে শঙ্খ নদীর চিত্র তুলে ধরি। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শঙ্খ নদীর ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে শঙ্খ নদীর চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া অংশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে টেকসই প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যে প্রকল্প এখনো চলমান রয়েছে। পরিকল্পিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা জানান তিনি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া) দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ বলেন, প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবান, চন্দনাইশের ধোপাছড়িসহ বিভিন্ন পাহাড়ে অতিরিক্ত গাছ কাটার ফলে পাহাড়ের শক্ত মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদীতে চলে আসে। এতে নদীর গভীরতা কিছুটা কমেছে।
নদী শাসনের ব্যাপারে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা ও ড্রেজিং ২ জাতীয় নদী শাসনই এখন চলমান আছে। ২০১৫-২০১৮ সালের প্রজেক্টে শঙ্খ নদীতে প্রায় সাড়ে ৯ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজ হয়েছে। ২০১৮-২০২৩ সালের প্রজেক্টে আরো ৬ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজ হচ্ছে। তিনি জানান, শঙ্খে ২১ কিলোমিটার ড্রেজিং হবে। ইতোমধ্যে সাতকানিয়ার চরতীতে ৪শ মিটার, আমিলাইশে ১.২ কিলোমিটার এবং বাঁশখালীর তৈলারদ্বীপ এলাকায় ৩শ মিটার ড্রেজিং কাজ শেষ হয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদে আরো ১৯ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাতারবাড়ী-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনসহ একনেকে ৯ প্রকল্প অনুমোদন
পরবর্তী নিবন্ধঅনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা রোধ করতে বাড়াতে হবে নজরদারি