শঙ্খচরে মুলা ৩ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা!

বিপদে কৃষক, উৎপাদন খরচ না ওঠায় মুলা ফেলে দিচ্ছেন অনেকে ক্ষেত থেকে তুলে ফেলে দিতেও লোকসান, হিমাগারের দাবি একইসাথে উত্তরবঙ্গের সবজি এসে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতি : কৃষি বিভাগ

মুহাম্মদ এরশাদ, চন্দনাইশ | সোমবার , ৬ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুমে এসে শীতের অন্যতম সবজি মুলা ও ফুলকপি নিয়ে বিপদে পড়েছেন শঙ্খচরের অসংখ্য কৃষক। উৎপাদন ভালো হলেও এখন মুলা ও ফুলকপি নিয়ে কৃষকদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। আগাম হিসেবে দুই আড়াই মাস আগে রোপিত মুলায় কৃষকরা ভালো দাম পেলেও শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুমে এসে মুলা ও ফুলকপির দাম নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। শঙ্খচরে উৎপাদিত মুলা কৃষক পর্যায়ে বর্তমানে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা, ফুলকপি ৪ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে অন্যান্য সবজির দামও নেমে এসেছে অর্ধেকের কমে।

মুলা ও ফুলকপিতে এমন পরিস্থিতি হয়েছে, ক্ষেত থেকে তুলে ফেলে দিতে শ্রমিক খরচও লোকসান দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শত শত হেক্টর জমির মুলা ও ফুলকপি তুলে ফেলে দিচ্ছেন কৃষক। কৃষকরা জানান, মুলা ও ফুলকপি ক্ষেত থেকে তুলে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিকেজিতে ৭ থেকে ৮ টাকা খরচ পড়ে। তাই উৎপাদন খরচও না ওঠায় কৃষকরা নিরুপায় হয়ে মুলা ক্ষেত থেকে তুলে ফেলে দিচ্ছেন। বর্তমানে একইসাথে উত্তর বঙ্গের সবজিও চট্টগ্রামসহ আশপাশের বিভিন্ন বাজারে এসে পড়ায় এ অঞ্চলের সবজির এমন দশা বলে মত দিয়েছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।

প্রতি মৌসুমে শঙ্খচরে ১৪ থেকে ১৫ কানি জমিতে সবজির আবাদ করেন কৃষক নুরুল ইসলাম নুরু। তিনি মুলা, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, ধনেপাতাসহ অন্যান্য সবজির আবাদ করেন। কিন্তু চলতি মৌসুমের মতো লোকসান কোনো মৌসুমে তার হয়নি। চলতি মৌসুমে মুলা, ফুলকপি ও বেগুনে তার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকা। এভাবে শঙ্খচরের শত শত কৃষকের একই দশা। শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুমে এসে মুলা ও ফুলকপির মতো পরিস্থিতি অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রেও। বিশেষ করে বেগুন প্রতিকেজি ৬৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

শঙ্খচরের কৃষক আবু বক্কর জানান, ১৫ দিন আগেও কৃষক পর্যায়ে মুলা প্রতিকেজি ৫০৬০ টাকা, বেগুন ৩০৩৫ টাকা, শিম ৫০৬০ টাকা, ফুলকপি ৫০৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে শিম ও ধনেপাতা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, সকল প্রকার সবজির দর পড়ে যাওয়ায় পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের কষ্টে উৎপাদিত সবজি। উৎপাদন খরচ না ওঠায় মুলা ও ফুলকপি মাঠেই ফেলে দিতে হচ্ছে। চলতি মৌসুমে মুলা ও ফুলকপিতে তার কমপক্ষে ৫ লাখ টাকার উপরে লোকসান হয়ে গেছে।

কৃষক মোজাম্মেল হক জানান, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত ফসল ফেলে দিলেও করার কিছুই নেই তাদের। কারণ এ অঞ্চলে হাজার হাজার টন সবজি উৎপাদন হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। এ অঞ্চলের কৃষকরা যুগ যুগ ধরে সবজি সংরক্ষণের জন্য হিমাগার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে এলেও সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি। মুলা ও ফুলকপির পাশাপাশি বেগুন ১০১২ টাকা, বরবটি ২৫ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৭৮ টাকা, কাঁচামরিচ ২৫ টাকা, টমেটো ২৮৩০ টাকা, ধনেপাতা ৩০৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ১৫ দিন আগেও এসব সবজির দাম দুই থেকে তিন গুণ বেশি ছিল।

কৃষক আবুল কাশেম জানান, প্রতি বছর শঙ্খচরের কৃষকরা লাখ লাখ টাকা লোকসান দিলেও কোনো সময় তারা সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। তারা যে চরে সবজির আবাদ করেন সে চরের অবস্থান দোহাজারী পৌরসভা ও সাতকানিয়ার কালিয়াইশের মধ্যবর্তী স্থান। তাই কোনো উপজেলা থেকে কৃষি প্রণোদনা তারা পান না। বিশাল চরে উৎপাদিত সবজির সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও কৃষি বিভাগ থেকে কোনো কর্মকর্তা এসে তাদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি ১ কানি জমিতে মুলা চাষ করেছেন, যা এখন বিক্রির উপযুক্ত সময়। কিন্তু উৎপাদন খরচ না ওঠায় ক্ষেতেই ফেলে রেখেছেন। জমির খাজনা নিয়ে ধারদেনা করে সবজির আবাদ করায় তিনিও অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

শঙ্খচরের কৃষক মোহাম্মদ মারুফ, মোহাম্মদ হাসান ও মাহামদ আলী জানান, প্রতি বছর শীতকালীন সবজির শুরুর দিকে তারা আগাম সবজি চাষাবাদ করতে পারলে লাভবান হন। জমিতে সেচ দিতে না পারা অথবা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবজি উৎপাদনে দেরি হলে তাদের লোকসান গুণতে হয় বেশি। তারা শঙ্খচরে উৎপাদিত সবজিতে সেচ সুবিধা পাওয়ার জন্য চরের বিভিন্ন পয়েন্টে গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। পাশাপাশি সুবিধাজনক স্থানে সবজি সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপনেরও দাবি জানান।

দোহাজারী ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সৈকত বড়ুয়া বলেন, এ অঞ্চলে উৎপাদিত সবজির সাথে উত্তর বঙ্গের সবজিও একইসাথে বাজারে আসায় বর্তমানে সবজির দাম কমে গেছে। যে সমস্ত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। পরবর্তীতে প্রণোদনা এলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হবে।

তিনি জানান, শঙ্খচরটির অবস্থান মূলত দোহাজারী এলাকায়। কিন্তু এখানকার অধিকাংশ কৃষক সাতকানিয়ার কালিয়াইশ ও খাগরিয়া অঞ্চলের। যার ফলে চন্দনাইশ থেকে তাদের প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সাতকানিয়া কৃষি অফিসের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশঙ্খচরে ৩ টাকা, শহরে কেন ৩০ টাকা
পরবর্তী নিবন্ধপিচ্চি জাহিদসহ ৯ জন গ্রেপ্তার