রাঙ্গুনিয়া উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা দক্ষিণ নিশ্চিন্তাপুর। এই গ্রামে পৌঁছলেই দূর থেকেই বাতাসে ছড়িয়ে থাকা গোলাপের মনোমুগ্ধকর সুবাস টের পাওয়া যায়। কাছে গেলে সড়কের পাশে বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে চোখে পড়ে বাহারি গোলাপের বাগান। ওই বাগানটি গড়ে তুলেছেন স্থানীয় যুবক মোহাম্মদ সেকান্দর হোসেন জুনু, যার ৪০ শতাংশ জমিতে সাজানো হয়েছে এই বাণিজ্যিক গোলাপ চাষ। এটি উপজেলার একমাত্র বাণিজ্যিক গোলাপ বাগান। বাগান থেকে তিনি দৈনিক গড়ে ৫০০–৭০০টি গোলাপ সংগ্রহ করেন এবং মাসে লাখ টাকার আয় করেন।
জানা যায়, এর আগে পোমরা, রাঙ্গুনিয়া কলেজ গেট, মোগলের হাটসহ বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দুই বছর আগে শখের বশে গোলাপ চাষ শুরু করেন সেকান্দর। ধীরে ধীরে এই বাগান তাকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। বর্তমানে তিনি সারা রাঙ্গুনিয়ার গোলাপের চাহিদা মেটাচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্যোমী যুবক সেকান্দর অন্যান্য ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু করার পরিকল্পনাও করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জমিজুড়ে ফুটেছে লাল, সাদা, হলুদ ও পিংক কালারের গোলাপ। শ্রমিকসহ তিনি জমির পরিচর্যা করছেন। কিছু তরুণ–তরুণী বাগানে সেলফি তুলছেন। সেকান্দর জানান, গোলাপের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতা থেকেই তিনি দুই বছর আগে দেড় হাজার গোলাপ চারা দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। এখন তার বাগানে রয়েছে তিন হাজার গোলাপ গাছ। যেখান থেকে অর্ডার অনুযায়ী ফুল সংগ্রহ করে বিক্রি করেন তিনি। তিনি জানান, ৪০ শতক জমি বাৎসরিক খাজনা হিসেবে নিয়ে যশোরের গদখালী নামক এলাকা থেকে চারা সংগ্রহ করে গোলাপ ফুলের চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। এরপর লাগানো, পরিচর্যা, খাজনাসহ সবমিলিয়ে তার ৫–৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। লাগানোর ৪৫ দিন পর কলি এলেও তা নিয়ম অনুযায়ী কেটে ফেলে দেন। এরপর গাছের ঢালপালা ছড়িয়ে দুই মাসের মধ্যে ফুল সংগ্রহ শুরু করেছেন। একেকটি ফুল ধরার পর ৫–৬ দিন পর্যন্ত ঠিকে থাকে। যা এক সপ্তাহের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।
মোহাম্মদ সেকান্দর হোসেন জানিয়েছেন, তার বাগান থেকে তিনি এখন নিয়মিত ফুল সংগ্রহ করেন এবং চন্দ্রঘোনা লিচুবাগানের তার নির্ধারিত বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। যেখান থেকে সারা রাঙ্গুনিয়ার ব্যবসায়ীরা ফুল সংগ্রহ করে নিয়ে যান। বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শীত মৌসুমে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়। প্রতিটি গোলাপ স্থানীয় বাজারে ৬ টাকা হারে বিক্রি হয়। সারাবছর ধরেই তার বাগানে ফুল ধরে। তবে অমাবস্যা–পূর্ণিমার সময় বেশি ধরে। সপ্তাহের প্রতিদিনেই অর্ডার থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার–শুক্রবার অর্ডার বেশি পান। এখন দৈনিক গড়ে অন্তত ৬০০টি ফুল বিক্রি করেন তিনি। যা থেকে দিনে ৩৬’শ টাকা এবং মাসে লাখ টাকা উপার্জন করেন বলে জানান তিনি।
সেকান্দর আরও জানান, লাগানোর পর তেমন আর কোন খরচ নেই। প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকার ঔষধ লাগে। শীতকালে কম লাগলেও বর্ষাকালে বেশি লাগে। একজন শ্রমিক মাসিক ১৮ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এর বাইরে কাজের প্রয়োজনে দুয়েকজন শ্রমিক মাঝেমধ্যে কাজে নেন।
গোলাপ বাগানে সমস্যা–সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি জানান, তার গোলাপ বাগানে ডাইব্যাক ভাইরাস আক্রমণ করে। এতে তার ১০০টির মতো গাছ মারা গেছে। তবে এই সংক্রমণ এখন আর নেই। কৃষি অফিসের পরামর্শে তিনি ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। এখন উপজেলার কোথাও বাইরে থেকে গোলাপ ফুল আনতে হয় না, তিনিই সব ফুল যোগান দেন। তবে অন্যান্য ফুলের চাহিদা মেটাতেও তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, আরও ৪০ শতক জমি নিয়েছি। যেখানে কালার স্টিক ফুল, রজনিগন্ধা, গাঁদা ফুলসহ বিভিন্ন ফুলের চাষাবাদ করবো। আগে ভিন্ন একটি ব্যবসায় করে উপার্জন করলেও এখন গোলাপ ফুল চাষাবাদেই তার জীবন বদলে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
গোচরা বাজারের ফুল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন বলেন, আগে শহরের চেরাগী পাহাড় এলাকা থেকে ফুল আনতে হতো। আনতেই অনেক সময় শুকিয়ে যেত, পরিবহন খরচ বেশি পড়ত। এখন গোলাপের জন্য শহরে যেতে হয় না। কম টাকায় গোলাপ ফুল পাওয়া যাচ্ছে উপজেলাতেই। তাজা ফুল কম দামে পাচ্ছেন তাই উপকৃত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বলেন, ফুল কাটা ও পরিচর্যার জন্য তাকে প্রণোদনা দিয়ে সহায়তাসহ স্বপ্রণোদিত হয়ে যোগাযোগ করে তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ফুলের দোকানদার তার কাছ থেকে এসে ফুল নিয়ে যান। শুধু তাকেই নয়, উপজেলায় ফুল চাষে চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই অন্যান্য চাষিদেরও প্রশিক্ষণ ও ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।












