গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে দেশের তিন জেলায় শিশুসহ ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় ৬ শতাধিক মানুষ। হয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ঢাকায় ৪ জন, উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে ৫ জন এবং নারায়ণগঞ্জে একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৯ জন এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে ১৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকার বাইরে গাজীপুুরে ৪০০শতাধিকসহ নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ মিলে আহত হয়েছেন ছয় শতাধিক মানুষ। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনের সকালে ১০টা ৩৮ মিনিটে এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৭; উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার পাশে নরসিংদীর মাধবদীতে। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী এ ভূমিকম্পে প্রাথমিকভাবে আতঙ্ক ছড়ায়, বাড়িঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ। এরপর আসতে থাকে প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
এই ভূখণ্ডে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পেরও ইতিহাস রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকের মধ্যে এমন প্রাণঘাতী ভূমিকম্প দেশের মানুষ আর দেখেনি। ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘দুটো প্লেটের সংযোগস্থলে এ ভূমিকম্পটি হয়েছে, ইন্দো–বার্মা টেকটোনিক প্লেটে। ভূমিকম্পের কম্পনের তীব্রতা ছিল বেশ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’ এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
হতাহতের চিত্র : ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ঢাকার আরমানিটোলার কসাইটুলি এলাকার একটি ৮ তলা ভবনের পাশের দেয়াল এবং কার্নিশ থেকে ইট ও পলেস্তারা খসে নিচে পড়ে, যেখানে একটি গরুর মাংস বিক্রির দোকান ছিল। সেখানে থাকা ক্রেতা ও পথচারীরা আহত হন। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই স্থানীয় লোকজন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা ৩ জনকে মৃত ঘোষণা করেন। বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন নিহতরা হলেন আনুমানিক ২২ বছর বয়সী রাফিউল ইসলাম, হাজী আবদুর রহিম (৪৭) ও তার ছেলে মেহরাব হোসেন রিমন (১২)।
রাফিউল ইসলাম স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমুহ) চিকিৎসক আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান।
রাজধানীর মুগদা মদিনাবাগ মিয়াজি গলিতে নির্মাণাধীন ভবনের রেলিং ধ্বসে পড়লে মাকসুদ (৫০) নামে এক নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পৌনে ১২টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।
মুগদা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আসাদুজ্জামান জানান, মাকসুদ মদিনাবাগ মিয়াজি গলির নির্মাণাধীন ভবনের নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন। ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে বাইরে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় ভবনের ওপর থেকে রেলিং ভেঙে তার মাথার ওপর পড়ে গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
সংবাদ পাওয়ার পর দুপুরে মুগদা হাসপাতাল থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয় এবং সন্ধ্যার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। নিহত মাকসুদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চড়সীতা গ্রামে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার একটি ভবনের দেয়াল ধসে দশ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। রূপগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুক্রবার সকালে উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকায় এ ঘটনায় শিশুটির মাসহ আরও দুজন আহত হন। নিহত শিশু ফাতেমা ওই এলাকার আব্দুল হকের মেয়ে; তিনি ঢাকার শ্যামবাজারে ব্যবসা করেন।
ভূমিকম্পের কারণে নারায়ণগঞ্জ বন্দর উপজেলায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে লাগা আগুনে একটি তুলার গুদাম পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতেই প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন। আহত হয়েছেন শতাধিক। নিহতদের মধ্যে সানশেড ভেঙে মাথায় পড়ে বাবা–ছেলে, দেয়াল চাপায় এক বৃদ্ধ ও গাছ থেকে পড়ে একজন মারা গেছেন। অপরজন প্রাণ হারিয়েছেন আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
সদর হাসপাতাল ও পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষসহ নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন এসব তথ্য জানিয়েছেন। নিহতরা হলেন– সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকার দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল (৪০) ও তার ছেলে হাফেজ মো. ওমর (৮), পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূইয়া (৭৫) ও কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে নাসির উদ্দিন (৬৫) এবং শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের আজকীতলা গ্রামের ফোরকান মিয়া (৪৫)।
যেভাবে মারা গেলেন তারা : ভূমিকম্পের সময় সদর উপজেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের গাবতলি এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল থেকে ইট ধসে পাশের বসতবাড়ির ছাদের ওপর আছড়ে পড়ে। এতে বাড়ির সানশেড ভেঙে দেলোয়ার হোসেন উজ্জ্বল. তার ছেলে মো. ওমর ও দুই মেয়ে আহত হয়।
তাদেরকে প্রথমে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাবা ও ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে নিয়ে গেলে ওমরকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। বাবা দেলোয়ার হোসেনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক।
ওমরের চাচা জাকির হোসেন বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় দেলোয়ার তার এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছিলেন। এসময় বাসার সানশেড ভেঙে তাদের উপর পড়ে দুইজন গুরুতর আহত হয়। পরে স্থানীয়রা তাদেরকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বাবা ও ছেলেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসলে চিকিৎসক ওমরকে মৃত ঘোষণা করেন।’ দেলোয়ারের দুই মেয়ে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ভর্তি আছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে ভূমিকম্পের সময় মাটির ঘরের দেয়াল ধসে প্রাণ হারিয়েছেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার মালিতা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজেম আলী ভূইয়া (৭৫)। তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ ও পরে নরসিংদী ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আব্দুল্লাহ আল মামুন।
অপরদিকে শিবপুর মডেল থানার ওসি মো. আফজাল হোসাইন বলেন, ভূমিকম্পের সময় গাছ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন শিবপুর ইউনিয়নের আজকীতলা পূর্বপাড়া গ্রামের শরাফত আলীর ছেলে ফোরকান মিয়া (৪৫)। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে নেওয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। এ ছাড়া ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ৬৫ বছরের নাসির উদ্দিন। তিনি কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ উদ্দিনের ছেলে। স্থানীয়দের বরাতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, ভূমিকম্পের সময় ফসলী জমি থেকে আতঙ্কিত হয়ে দৌঁড়ে আসার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হন নাসির উদ্দিন। রাস্তা থেকে নিচে পড়ে ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করায় নিকটাত্মীয়রা তার লাশ হাসাপাতালে নেননি।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন শতাধিক : ভূমিকম্পে শহর–গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ভবন, বসতবাড়ি, মার্কেট ও দোকানপাট থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হয়েছেন। এছাড়া ভূমিকম্পের সময় অনেকে মাথা ঘুরপাক খেয়ে বা বুকে ব্যথা নিয়ে পড়ে গিয়েও আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহতদের মধ্যে নরসিংদী সদর হাসপাতালে ৫৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালে ১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়া পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ধশত চিকিৎসা নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন সিভিল সার্জন সৈয়দ আমীরুল হক শামীম।
বিভিন্ন ভবনে ফাটল, মাটি ফেটে চৌচির : ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় অনেক ভবন হেলে পড়া ও ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে বড় কোনো ভবন ধসের ঘটনা না ঘটলেও সার্কিট হাউসহ অনেক ভবন ও বাড়িঘরে ছোট বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। হেলে গেছে একটি ভবন। এর মধ্যে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের চারটি আবাসিক ভবনে কিছুটা ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ঘোড়াশালের লেবুপাড়া এলাকায় ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্মের মাঠের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন টিমের মাধ্যমে সমন্বয় করে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা মতে পরবর্তীতে সবধরনের সহায়তা করা হবে।
ভূমিকম্পের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ভূমিকম্প টের পেয়ে আতঙ্কিত মানুষ ছুটে ভবনের নীচে নেমে ফাঁকা জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বহুতল ভবনগুলোতে মানুষ পিলার ধরে থাকার কথা জানিয়েছেন। অনেকে ভূমিকম্পের সিসি ক্যামেরার ভিডিও শেয়ার করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল, কবি জসীমউদ্দিন হল, স্যার এ এফ রহমান, মোকাররম ভবন, শেখ ফজলুল হলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের একটি কক্ষের জিনিসপত্র তছনছ হয়ে গেছে।
ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড : নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে জাতীয় গ্রিডের সাবস্টেশনের যন্ত্রাংশ পুড়ে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে জানান পলাশ ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মো. আব্দুল শহিদ।
ভূমিকম্পের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড–পিডিবি। বোর্ড জানিয়েছে, উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। পিডিবি এক বার্তায় বলেছে, ‘শক্তিশালী ভূমিকম্পজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ কিছু সময়ের জন্য বিঘ্নিত হয়েছে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক।












