অফিস ছুটি হলে স্কুল ছুটির মজা পাই! কি আজব একটা দিন ছিল, স্কুল মানেই হাবিয়া দোজখ, মাইর ছাড়া চলেই না, পালালেই বাঁচি। অফিসে টাকা আসে বলে, ওসব ফিলিংস বাজে বলে উড়িয়ে দিই!
মিছে লকডাউনের তোড়ে বেশ নোট খরচ হয়ে যায়, দশ টাকার ভাড়া বিশ টাকা দিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে চলে আসি ঘাটে। ইঞ্জিন বোটে প্রমত্তা কর্ণফুলী পার হওয়াটা ভীষণ উপভোগ করি। ঢেউ দেখলে অনেকেই কেমন খাঁচার পাখির দশা হয়, আমি মনে-মনে হাসি, এ-হাসি দেখানো যায় না। ১১ নাম্বার ঘাটের মুখেই ভ্যানে আম বিক্রি হচ্ছে, আমার সাথে সেয়ানা শরিফ ভাই, অফিস সিনিয়র, তিনি বিকিকিনির ওস্তাদ লোক। আমিও জেতার লোভে লাইনে খাড়া। ‘গন্ধ শুঁকে নিতে হবে, ল্যাঙড়া ছোট নিয়েন না।’ গুরুমন্ত্র পরখ করতে নিলাম দু’কেজি, গতকাল তিন কেজি নিয়ে ধরা খেয়েছি, এবার সামলে। ভাই কালো পলিথিনে দিয়ো, রাস্তায় সবাই আবার দাম জিজ্ঞেস করবে। কালো পলিথিন তিন কেজির ক্রেতা পেলেন, আমারটা ট্রান্সপারেন্ট সাদা। গন্ধ মৌ মৌ করছে, আজ জিব ঝুলে যাবে। গ্রামের বাজারে নেমে একটু জোরে হাঁটছি, পরিচিত দোকান মালিক ডাক দিলেন – ভাই পুত, আম হাঁড়িভাঙা না? আমি বললাম – ল্যাঙড়া! তিনি মুচকি হেসে বললেন- আস্তে আঁইট্ট, পরি আবার…। কালো পলিথিনটা হলে এই কথা শুনতে হত না। ভাঙা ইটের রাস্তা ধরে সবুজ জমিনের মাঝে বাড়ির রাস্তা, দূরে দ্বীপের মতো শ্মশান দেখা যাচ্ছে, বট গাছসহ এ-দৃশ্য নৈসর্গিক, কত দেখি সজীবতা কমেই না। ‘নমস্কার’ বলে কে যেন দৃশ্যের মাঝখানে দাঁড়াল। গলাটা পাড়ার ছেলেদের মতো নয়, পিছু ফিরে তাকালাম – লোকটা তখন তাকিয়ে আছে আমের ঠোঙাটার দিকে, চিনতে পেরেছি- বিস্কুট ফ্যাকটরিতে কাজ করে। ভদ্রতা হেতু বললাম ‘ল্যাঙড়া আম, রাস্তাত গম লাইগগি, লইচাই দুই কেজি।’ লোকটা ‘মজা অইবু’ বলে হেসে চলে গেল। সাধারণ কৌতূহল মনে হলেও, লোকটার মনে বোধ হয় আর কিছু ছিল। দূর্গা মন্দির পড়ে মাঝপথে, দুয়ার খোলা, দশভূজা দেখে প্রতিদিন গুণগুণ করি – ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে/ তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে। মা ডান হাতের খড়গ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিখে, আমের ঠোঙ্গা হাতে এ-অসুর চলে আসে। পথমধ্যে লোকটার প্রতিবেশী ছেলে একটার কাছে তথ্য নিলাম। ‘লকডাউনুর আগে চরি গইত্তু এহন কিচ্ছু নগরে, হষ্টত আছে।’ কি করা যায় ভাবছি- নিজে কিছু দেব, কলিগ ক’জনকে বলব কিছু দিতে, না না তাদের বলতে গেলে আবার কি ভেবে বসে। বাড়িতে গিয়ে গোসল করতে ছুটলাম পুকুরে, বহুদিন পর পুকুর টইটম্বুর হয়েছে, মাকে ডাক দিয়ে বললাম – ‘আম দুইমিক্কের দুউওয়া হাড।’ ফালি করা আম থেকে মধুর গন্ধ ছড়াচ্ছে, মাছির দল নেমে এসেছে, নিশ্চয়ই ফরমালিন নেই। চেটেপুটে খাবার বাসনায় একফালি হাতে নিলাম। কে যেন নমস্কার দিল, লোকটা ফালি করা আমের দিকে তাকিয়ে আছে, হাত অসাড় হয়ে গেল, আম নয় দগদগে ঘা যেন বসে আছে হাতে!