বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটি আরামদায়ক, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ পরিবহন হিসেবে ভাবেন সাধারণ যাত্রীরা। এছাড়া তুলনামূলক পরিবেশ দূষণ, স্বল্প জ্বালানি খরচ ও দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি কম হওয়ার সুবাদে রেলওয়ে অধিক জনপ্রিয় পরিবহন মাধ্যম। সম্প্রতি বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় জনসাধারণের যাতায়াত আরো সহজ হচ্ছে এবং পরিবহন ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাচ্ছে, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, শিল্পায়নের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটছে এবং দারিদ্র্য হ্রাসসহ আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কালের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় প্রশাসনিক সংস্কার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমান ব্যাপক উন্নয়ন পর্যায়ে এসেছে। রেলওয়ে দেশের বর্তমান পরিবহন চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ খাতে উন্নয়নের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ বা মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। রেলওয়ের অনেক সুযোগ–সুবিধাপ্রাপ্তির মাঝেও বেশ কিছু বিষয়ে উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে জনসাধারণের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গত ১৫ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে তেমন এক প্রতিবেদন : ‘স্টেশন আছে, থামে না ট্রেন/ কেন অবহেলার শিকার–প্রশ্ন লোহাগাড়াবাসীর’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধনের এক বছর পার হলেও লোহাগাড়া রেল স্টেশনে থামছে না কোনো ট্রেন। এতে স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কেন অবহেলার শিকার হচ্ছেন এখন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে লোহাগাড়াবাসীর মনে। দ্রুত লোহাগাড়া রেল স্টেশনে ট্রেন থামানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ চেয়েছেন স্থানীয়রা। জানা যায়, এই রুটে পর্যটক এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এঙপ্রেস ও ঈদ স্পেশাল নামে ৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন নিয়মিত চলাচল করে। এরমধ্যে পর্যটক ও কঙবাজার এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ননস্টপ চলাচল করে। আর ঈদ স্পেশাল ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে ষোলশহর, জানালীহাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা ও রামু স্টেশনে থেমে কঙবাজার রেল স্টেশনে গিয়ে যাত্রা শেষ করে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মানুষ প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত ভাড়া ও যানজটসহ নানা ভোগান্তি নিয়ে সড়ক পথে যাতায়াত করেন। কিন্তু রেল লাইন চালুর কিছুদিন পর থেকে ওই রুটে ঈদ স্পেশাল ট্রেন চালু হওয়ায় অনেক এলাকার মানুষ ট্রেন যাত্রার সুবিধা ভোগ করতে পারলেও বঞ্চিত লোহাগাড়ার মানুষ।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে ৮টি স্টেশনে ট্রেন থেমে যাত্রী উঠানামা করলেও লোহাগাড়া রেলস্টেশনে থামছে না ট্রেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান জানান, ঈদ স্পেশাল ট্রেন মূলত ঈদের আগে–পরে কয়েকদিন চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে চলাচলের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু যাত্রী চাহিদার কারণে সেটি আর বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় কোনো কারণে হয়তো লোহাগাড়া রেলস্টেশনে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
আজাদীতে এমন দিনে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, যেদিন রেল দিবস হিসেবে পালিত হয়। উল্লেখ্য, ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম রেল যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ভারত থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হয়ে জগতি রেলস্টেশনের জন্ম হয়। এই দিনে প্রথম চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন চালু হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশে রেললাইন চালুর ১৬২ বছর পূর্তি হলো। বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেললাইন নেটওয়ার্ক দেশের ৪৪টি জেলায় সংযুক্ত। ১৯৪৭ সালের পূর্বে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন রেলওয়ে পরিচালিত হতো। ১৯৭৩ সালে বোর্ডের কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
পত্রিকান্তরে রেলওয়ের মহাপরিকল্পনা প্রকাশিত হয়েছে। সেই তথ্যে জানা যায়, ২০৪৫ সালের মধ্যে ছয় লাখ কোটি টাকার ২৩০টি প্রকল্প ছয় ধাপে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নের পরে রেলযাত্রীদের সেবা পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে। রেলের অবকাঠামো উন্নয়নে গত ১০ বছরে ব্যয় অনেক বাড়লেও যাত্রীসেবার মান সেই অনুপাতে বাড়েনি। তাছাড়া রেলওয়ের আরও কিছু সমস্যার মধ্যে রয়েছে জনবলের ঘাটতি। এ কারণে ১২৩টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে আছে। পর্যাপ্ত সংখ্যায় নতুন ট্রেনচালক তৈরি হচ্ছে না। রেললাইনের অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় ট্রেন চলাচলের গতি কমেছে। এ ছাড়া রেলের কারখানাগুলোয় জনবল সংকটের কারণে ট্রেনের মেরামত কাজ বিলম্বিত বা অনিয়মিত হচ্ছে। এসব সমস্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে যাত্রীসেবায়। এ বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। লোহাগাড়া রেল স্টেশনের মতো আরো যতগুলো স্টেশন বন্ধ আছে, অথবা ট্রেন থামে না; সেই স্টেশনগুলো চালু করার পদক্ষেপ নিতে হবে। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে আরো নতুন ট্রেন যুক্ত করতে হবে। রেলওয়ের যতসব সুযোগ সুবিধা পাওয়া থেকে যাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, সেসব বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে।